বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ দীর্ঘদিন ধরে পানিস্বল্পতা, খরা ও ভূগর্ভস্থ পানির দ্রুত নিম্নগতির মারাত্মক সংকটে ভুগছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ ইন্ডিয়ার সীমান্তে মুর্শিদাবাদ জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গায় নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ। ১৯৬২ সালে শুরু হয়ে ১৯৭০ সালে শেষ হওয়া এ ব্যারাজ নির্মাণের সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কোনো আপত্তিই জানায়নি, যা নিয়ে আজও প্রশ্ন রয়ে গেছে। ব্যারাজ নির্মাণকালে পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে রাজনৈতিক বলয় ছিল দুর্বল। পশ্চিম পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রশক্তির কাছে পূর্বাঞ্চলের উদ্বেগ গুরুত্ব পায়নি। সেই সুযোগে গঙ্গার প্রধান প্রবাহ হুগলি নদীর দিকে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া হয়, যা বাংলাদেশের নদীব্যবস্থার ওপর দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয় ডেকে আনে। ১৯৭৫ সালে এটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৬ মে ১৯৭৬ সালে ফারাক্কাবাঁধের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক লং মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের লাখো মানুষ পানির ন্যায্য হিস্যা দাবি ও ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবের প্রতিবাদে দীর্ঘ পদযাত্রায় অংশ নেয়। আমি যতদূর জানি, পরিবেশ রক্ষায় গণমানুষের এমন ব্যাপক অংশগ্রহণ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
গঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের পর যার নাম হয় পদ্মা, একসময় ছিল প্রাণবন্ত, শক্তিশালী নদী। আজ তার সেই রূপ নেই। উল্লেখযোগ্যগবেষণা বলছে –
• ৪০ বছরে পদ্মার পানিপ্রবাহ কমেছে প্রায় ৩০%
• স্থায়ী জলাধারের আয়তন কমেছে ৫০% এরও বেশি
• নদীকেন্দ্রিকজীববৈচিত্র্যমারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত
রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল আজ চরম জলসংকটে ভুগছে। এই বছর (২০২৫ সালে) ২৮ অক্টোবর একটি গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ঘোষণা দেওয়া হয় যে, উত্তর-বাংলার হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চলে ৪৭টি ইউনিয়ন (২৫টি উপজেলা) গুরুত্বপূর্ণভাবে “চরম বা অত্যন্ত উচ্চ জলসংকট” এলাকায় পড়েছে, এসব ইউনিয়ন রয়েছে- রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁও জেলা-অঞ্চলে। কৃষি, মৎস্য, নৌপরিবহন, এমনকি বাড়িঘরের পানির চাহিদা, সব ক্ষেত্রেই সঙ্কট প্রকট। বারেন্দ্র অঞ্চলে পানির টিউবওয়েলগুলোতে পানির স্তর প্রতি বছরই নীচে নেমে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি নির্বিচারে উত্তোলন আর নতুন পানির উৎস না থাকায় পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
প্রতি বছর জুলাই–সেপ্টেম্বরে উজানের বন্যার কারণে ফারাক্কাবাঁধের গেট খুলে দিলে পদ্মা কিছুটা পানি ফিরে পায়। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে এ সময় পানি প্রায় ২০ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এ পানি অল্প সময়ের জন্য হলেও নদী ও পরিবেশকে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু, এই সাময়িক পানিকে সংরক্ষণে বাংলাদেশে নেই কোনো শক্তিশালী উদ্যোগ। প্রাথমিক ভাবে আমাদের অন্যতম করণীয়, গভীর জলাশয় খনন-
• পরিত্যক্ত জমিতে হাজার হাজার গভীর রিজার্ভার খনন করতে হবে। তবে এগুলো মাছ চাষের জন্য অগভীর পুকুর নয়; অবশ্যই গভীর জলাধার হতে হবে।
• সেগুলোকে ক্লাস্টার আকারে সাজিয়ে ড্রেন/পাইপের মাধ্যমে সংযুক্ত করতে হবে।
• প্রতিটি ক্লাস্টারকে সরাসরি পদ্মা নদীর সঙ্গে যুক্ত রাখতে হবে, যাতে বর্ষায় সংরক্ষণ করা পানি খরায় ব্যবহৃত হয়।
• বর্ষার বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করতে পারলেই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমবে।
ইন্ডিয়ার হুগলি নদীতে ন্যায্য প্রাপ্য পানির প্রবাহ যোগ হলেও, তা উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম জেলা রাজশাহীর কাছে আসে না। বাংলাদেশের নবাবগঞ্জের নিকটবর্তী, পদ্মা নদীর কাছাকাছি ইন্ডিয়ার বসুদেবপুর এবং লালগোলা অংশে, হুগলি নদী দিয়ে পদ্মার পানির গতিপথ পরিবর্তন করে নেয়া হয়েছে। ভারতের বসুদেবপুর অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের শিবগঞ্জের দূরত্ব মাত্র প্রায় ৮ কিলোমিটার। ইন্ডিয়ার লাল গোলার পানি প্রবাহের স্থান থেকে বাংলাদেশের গোদাগারি মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে! আমাদের ভূগর্ভস্থ পানির সুনির্দিষ্ট পরিমাণ জানতে হবে! এজন্য হাইড্রোজিওলজিক্যাল (জল-ভূতাত্ত্বিক) গবেষণা অত্যাবশ্যক। বর্তমান ভূগর্ভস্থ পানির মানচিত্র থাকা উচিত। তিক্ত হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানির পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র নেই, আমরা জানি না আমাদের নিচে কত পানি আছে, কোথা থেকে হারাচ্ছি, কোথায় পুনর্ভরণ সম্ভব। আর তাই প্রয়োজন–
• বিস্তৃত হাইড্রোজিওলজিক্যাল স্টাডি,
• জিআইএস মানচিত্র,
• পানির রিচার্জ–অঞ্চল শনাক্তকরণ,
• নিয়মিত পর্যবেক্ষণ।
নদীকে বাঁচাতে ড্রেজিং অপরিহার্য, আর তাই–
• পদ্মা নদীর মূল নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে বড় ধরনের ড্রেজিং প্রয়োজন।
• নদীর গভীরতা সম্ভবত হুগলি নদীর সমান কিংবা বেশি দরকার হতে পারে।
• তবে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ছাড়া সিদ্ধান্ত নেওয়া বিপজ্জনক।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ইন্ডিয়ার একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণ আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত Convention on the Law of the Non-Navigational Uses of International Water courses হলো একটি আন্তর্জাতিক কাঠামো-চুক্তি, যা আন্তঃসীমান্ত নদী ও সংশ্লিষ্ট ভূগর্ভস্থ পানির ন্যায্য, টেকসই ও সহযোগিতা মূলক ব্যবহারের নীতি নির্ধারণ করে। জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক জলপথ আইনে স্পষ্ট বলা আছে–
• কোনো দেশ সীমান্তনদীর পানি একতরফা ভাবে বাঁধতে বা প্রবাহ কমাতে পারে না।
• তা করলে নিম্নগামী দেশের অস্তিত্ব ও পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ে।
• এর ফলে কূটনৈতিক সংঘাত, আন্তর্জাতিক মামলা এবং অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে।
শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কার সব গেট বন্ধ রাখা বাংলাদেশে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও “অনৈতিক ও অযৌক্তিক”। যদিও বাংলাদেশ ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘে ভোট দেওয়ার সময় এই আইনকে সমর্থন করেছিল, তবে কোনো এক অদৃশ্য কারণে, বিগত ২৮ বছরে চুক্তিতে আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ (ratification/accession) করেনি। অত্যান্ত হাস্যকর যে, বাংলাদেশ–ইন্ডিয়া পানি বণ্টন এখন মূলত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির (যেমন ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তি) মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যেখানে বাংলাদেশকে শুধুমাত্র বন্যার সময় ডুবানোর হুমকি দেয়া হয়, আর খরার মৌসুমে পানি শূন্য খটখট করে। কনভেনশনে যোগ না দিলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক জলবিরোধ নিষ্পত্তি (আর্টিকেল ৩৩) সরাসরি ব্যবহার করতে পারবে না। আর যোগ দিলে, বাংলাদেশ তার “নিম্নধারার অধিকার” রক্ষায় আরও শক্ত আন্তর্জাতিক ভিত্তি পেতে পারে, উজানের দেশের ওপর নৈতিক/কূটনৈতিক চাপ বাড়াতে পারে। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯২ সালের UNECE Transboundary Water Convention অনুমোদনের ঘোষণা দেয়, যা আরেকটি আন্তর্জাতিক জলচুক্তি। এটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ১৯৯৭ সালের UN Watercourses Convention ও অনুমোদন করতে পারে। এই কনভেনশনে যোগ দিতে হলে দেশের ভেতরে কয়েকটি আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করা প্রয়োজন -
• পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের বাধ্যবাধকতা,
• তথ্য ভাগাভাগির নিয়ম,
• পানি-বিরোধ নিষ্পত্তির অভ্যন্তরীণ আইন,
• নদী-নির্ভর গবেষণা ইউনিটের জোরদার ইত্যাদি।
পানি সংরক্ষণ, গবেষণা, ড্রেজিং এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা ছাড়া উত্তরবঙ্গের সংকট কাটবে না, বরং দিন দিন পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। শুষ্ক পদ্মার জন্য, রাজশাহী শহর শুধু পানি সংকটের মুখেই নয়, তীব্র বায়ু দূষণ ও অতি গরমের হুমকির মুখে। এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র চরম হুমকির মুখে।
এফপি/এমআই