বারবার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে শুধু ভূমি নয়, মানুষের মনও। রাজধানীসহ সারাদেশে গত শুক্রবার সকালের দুলুনিতে যে আতঙ্ক তৈরি হয়, তার ধাক্কা এখনও সামলাতে পারেননি অনেকে। কয়েক সেকেন্ডের আকস্মিক ঝাঁকুনিতে ক্ষতিগ্রস্ত আবাসিক ভবনের অবকাঠামো। এতে ১০ জনের প্রাণহানি ও আহত হয় সাত শতাধিক মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্প বাংলাদেশে তুলনামূলক কম ঘটায় মানসিক প্রস্তুতি কম। তাই মাঝারি মাত্রার এই কম্পনও মানসিক স্বাস্থ্যে বড় ধাক্কা দিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত শনিবার রাত ৮টা পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে ৬৮০ জন আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। এখনও ভর্তি রয়েছে ২০৩ জন। বেসরকারি হাসপাতালেও রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। তবে শারীরিক আঘাতের চেয়েও বড় উদ্বেগের জায়গা হয়ে উঠেছে মানুষের মন। ৩১ ঘণ্টার মধ্যে চারবার ভূমিকম্পের পর অনেকে এখনও স্বাভাবিক হতে পারেননি।
ঘুমোতে গেলেও মনে হয় খাট দুলছে
রাজধানীর কলাবাগানের বাসিন্দা চাকরিজীবী তরিকুল ইসলাম বলেন, ভূমিকম্প শুরু হতেই দ্রুত বাসা থেকে আমরা নিচে নেমে আসি। রাতে ঘুমোতে গেলেও মনে হচ্ছিল খাট দুলছে। সব সময় তীব্র মাথাব্যথা করছে। চোখ খুললেও মনে হচ্ছে ঘর কাঁপছে। ঠিকমতো ঘুম হয়নি। সকালে উঠেও মাথা ঘোরে, শরীর দুর্বল লাগে। কাজে মনোযোগ দিতে পারছি না। পরিবারের অন্য সদস্যদেরও একই উপসর্গ দেখা গেছে। তাঁর স্ত্রী আতঙ্কে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে চাচ্ছেন।
এসব সমস্যায় চিকিৎসা নিতে রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গতকাল রোববার আসে বেশ কয়েকজন। তাদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্পের আকস্মিকতা মানুষের মধ্যে অতিরিক্ত ভীতি, প্যানিক অ্যাটাক, ঘুমের ব্যাঘাত, বিভ্রান্তি ও ঝাঁকুনির মতো অনুভূতির উপসর্গ তৈরি করে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মুনতাসীর মারুফ বলেন, ভূমিকম্পের মতো হঠাৎ দুর্যোগ মানুষের চিন্তা ও অনুভূতিকে তীব্রভাবে নাড়া দেয়। এই মানসিক চাপ অনেক সময় এতটা বেড়ে যায় যে, তা দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত করে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে (পিটিএসডি) রূপ নিতে পারে। নারী ও শিশুদের মধ্যে এ প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। পিটিএসডিতে ভয়াবহ ঘটনার স্মৃতি বারবার ফিরে আসে; শব্দ, দৃশ্য বা আলাপ সেই আতঙ্ক জাগিয়ে তোলে। দুঃস্বপ্ন, ঘটনা-সংক্রান্ত বিষয় এড়িয়ে চলা, আবেগ প্রকাশে অসুবিধা, গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভুলে যাওয়া এসবই সাধারণ লক্ষণ। এ ছাড়া দেখা দিতে পারে মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, বুক ধড়ফড়, হাত-পা কাঁপা ও খাওয়ায় অরুচির মতো শারীরিক প্রতিক্রিয়াও। অনেকে বিষণ্নতা বা অপরাধবোধে ভোগেন। ওষুধ, সাইকোথেরাপি, গ্রুপ থেরাপি ও ইএমডিআরসহ (এক ধরনের মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি) সমন্বিত চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। এটি দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও চাপ মোকাবিলার প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বজুড়ে গবেষণায় মিলছে একই চিত্র
যুক্তরাজ্যভিত্তিক বৈজ্ঞানিক সাময়িকী বায়োমেড সেন্টারের বিএমসি সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভূমিকম্পের পর এক লাখ মানুষের মধ্যে ১৮ হাজারেরই পিটিএসডি ভোগা রোগী পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তুরস্কে ২০২৩ সালের ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের এক বছর পরও সেই দেশের মানুষের মধ্যে উচ্চমাত্রার ট্রমা দেখা গেছে। এই গবেষণায় অংশ নেওয়া আড়াই হাজার মানুষের অর্ধেকেরই গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ৬০ শতাংশের মধ্যে তীব্র পোস্ট-ট্রমাটিক উপসর্গ, ৪৪ শতাংশের মধ্যে উদ্বেগ এবং ৬১ শতাংশের মধ্যে উচ্চ মাত্রার বিষণ্নতা পাওয়া গেছে। জাপান, চীন ও নেপালের মতো ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলোতে করা আরও অনেক গবেষণায় একই ধরনের ফল পাওয়া গেছে। সে সব দেশে ভূমিকম্পের মতো আকস্মিক দুর্যোগের পর জনসাধারণের গুরুতর চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক ধাক্কা সামাল দিতে জাতীয় নীতিমালা রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই ধরনের দুর্যোগে কেমন মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয় এবং এটি কমাতে নানা ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকে। তবে বাংলাদেশেও এমন উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বাড়ছে দীর্ঘ মেয়াদে শারীরিক ঝুঁকিও
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, দীর্ঘদিনের মানসিক চাপে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও কিডনির জটিলতার মতো দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যা বাড়ছে।
মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. জোবায়ের মিয়া বলেন, সাম্প্রতিক ভূমিকম্প মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যে বড় ধাক্কা দিয়েছে। অনেকের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে, কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না। গত দুই দিনে প্যানিক অ্যাটাকে (ভীতি ও উদ্বেগের অনুভূতি, যা হঠাৎ করে আমাদের হতবিহ্বল করে দিতে পারে) আক্রান্ত বেশ কয়েকজন রোগী এসেছে। এ পরিস্থিতিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দ্রুত সেবার আওতায় আনতে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটসহ হাসপাতালগুলোতে আলাদা ইউনিট চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেখানে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। প্যানিক অ্যাটাক কমাতে স্বাভাবিক জীবনযাপনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত খাবার, আতঙ্ক ছড়ায় এমন সংবাদ থেকে দূরে থাকা এসব মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করাও জরুরি।
এফপি/অ