Dhaka, Tuesday | 18 November 2025
         
English Edition
   
Epaper | Tuesday | 18 November 2025 | English
হাসিনা-কামালের বিচারে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের মানদণ্ড পূরণ হয়নি
এবারের নির্বাচন দেশ রক্ষার: প্রধান উপদেষ্টা
ঢাকার আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে
হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়ে গণ সিজদাহ্
শিরোনাম:

বেকারত্ব ঘোচাতে মানসিক পরিবর্তন জরুরি

প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৫, ১:৪২ পিএম  (ভিজিটর : ৮)

আল্লাহ মানুষকে জীবিকার জন্য নানা পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়, আল্লাহ মানুষের রিজিকের ৯০ শতাংশ রেখেছেন ব্যবসা-বাণিজ্যে আর মাত্র ১০ শতাংশ রেখেছেন চাকরি এবং অন্যান্য পেশায়। কিন্তু বাস্তবে আজকের বাংলাদেশে দেখা যায়, প্রায় ১০০ শতাংশ মানুষই জীবিকার উৎস হিসেবে সেই ১০ শতাংশের মধ্যেই রিজিক খুঁজছে। অর্থাৎ, আমরা রিজিকের প্রকৃত উৎস থেকে দূরে সরে গিয়ে সীমিত ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ এক পথে ছুটে চলেছি—যা কোনোভাবেই টেকসই বা সফলতার নিশ্চয়তা দিতে পারে না।

এর ফল আমরা প্রতিনিয়ত ভোগ করছি। বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ থেকে পাস করেই অধিকাংশ তরুণের প্রথম ও একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়—একটি ‘ভালো চাকরি’ পাওয়া। সরকারি চাকরির জন্য বিসিএস, ব্যাংক, এনজিও বা বেসরকারি কোম্পানির নিয়োগ পরীক্ষায় তারা বছরের পর বছর সময় ব্যয় করে। অথচ এ সময়ে তারা যদি নিজের উদ্যোগে কিছু গড়ে তোলার চেষ্টা করত, তবে হয়তো নিজেদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করার পাশাপাশি অন্যদেরও কাজের সুযোগ দিতে পারত। ফলে স্বল্পশিক্ষিত ও নিম্ন আয়ের পরিবারের যেসব তরুণ ছুটে যাচ্ছে দেশের বাইরে—নির্মাণশ্রমিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ নানা ধরনের অতিশ্রমসাধ্য কিন্তু কম পারিশ্রমিকের কাজে যুক্ত হতে, তাদের বেশিরভাগেরই দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতো। উল্লেখ্য, এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশের অর্থনীতি সচল থাকলেও, একদিকে বিদেশ-বিভুঁইয়ে কঠোর শ্রম ও নিঃসঙ্গতা, অন্যদিকে পরিবার ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অবিরাম দুশ্চিন্তা—তাদের মানসিক ও শারীরিক শক্তিকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে ফেলে। একই সঙ্গে তাদের দীর্ঘ অনুপস্থিতি পরিবারে শূন্যতা সৃষ্টি করে; ফলে স্ত্রী-সন্তানরা প্রায়ই নানা সামাজিক অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলায় জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়ে।

কিন্তু আমাদের সমাজ ও পরিবার আজও তরুণদের শেখায়—‘ভালো চাকরি পাওয়া মানেই জীবনের সফলতা।’ ফলে, উদ্যোক্তা হওয়া মানে ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা এবং ‘অন্যরকম কিছু’—এমন এক ধারণা সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে।

এ প্রবণতার পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রভাব। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে প্রশাসনিক কাঠামো চালাতে ইংরেজদের প্রয়োজন ছিল অনুগত ও শিক্ষিত কর্মচারী—যারা নিজেরা চিন্তা করবে না, শুধু আদেশ পালন করবে। তাই শিক্ষা ব্যবস্থাকেও এমনভাবে সাজানো হয়েছিল, যাতে মানুষ স্বাধীনভাবে চিন্তা না করে, বরং চাকরির উপযোগী ‘কর্মচারী’ হিসেবে গড়ে ওঠে। তখন থেকেই আমাদের সমাজে ‘চাকরি’ মানেই মর্যাদা, নিরাপত্তা ও সাফল্যের প্রতীক আর ‘ব্যবসা’ মানে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি।

এ মনস্তাত্ত্বিক দাসত্ব আজও টিকে আছে। আমাদের পরিবারগুলো সন্তানের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে একমাত্র চাকরির দৃষ্টিকোণ থেকে। পিতা-মাতা, শিক্ষক এমনকি সমাজও সন্তানের সাফল্য মাপে তার চাকরির পদবি দিয়ে—ব্যবসা বা উদ্যোগ দিয়ে নয়। ফলে তরুণরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেওয়ার পর থেকেই চাকরির দৌড়ে নামে এবং বেশিরভাগই ব্যর্থ হলে হতাশায় ভোগে। উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা তাদের মনে আসে না—যতক্ষণ না জীবন বাধ্য করে বা অন্য কোনো বিকল্প থাকে না।

কোরআনের আলোকে বিচার করলে দেখা যায়, ইবলিস মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য নানা ফাঁদ পেতে রেখেছে। তার অন্যতম কৌশল হলো—মানুষকে নিজের ক্ষমতা ও সৃজনশীলতার ওপর অবিশ্বাসী করে তোলা। আজকের সমাজে ইবলিসের এ কৌশল বেশ সফল হয়েছে। সে আমাদের বিশ্বাস করিয়ে দিয়েছে, চাকরিই সম্মানজনক, ব্যবসা-বাণিজ্য অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে আমরা নিজেদের দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও সাহসকে দমন করে ‘নিরাপদ বন্দিত্বে’ আশ্রয় নিয়েছি।

আমরা এখন এমন এক সমাজে বাস করি, যেখানে তরুণরা নিজের দক্ষতার চেয়ে বেশি নির্ভর করে সরকারি বা বেসরকারি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ওপর। চাকরি না পেলে তারা নিজেদের ব্যর্থ মনে করে, অথচ উদ্যোক্তা হওয়ার বা বিকল্প পথ ভাবার সাহস তাদের থাকে না। আমরা কাজ চাই, কিন্তু কাজ তৈরি করতে চাই না। আমরা চাকরিদাতা হতে চাই না, চাকরিপ্রার্থী হয়েই সন্তুষ্ট থাকি। এই মানসিক অবস্থা আসলে আমাদের আত্মবিশ্বাস, সৃজনশীলতা ও ইমানি দৃঢ়তা দুর্বল করে দিচ্ছে।

চাকরিনির্ভর সমাজ এক অর্থে মানসিক দাসত্বের সমাজ। এখানে মানুষ নিজের যোগ্যতা ও সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অন্যের অনুমতির অপেক্ষায় থাকে। চাকরি মানে অনেকের কাছে ‘নিরাপত্তা’, কিন্তু বাস্তবে এটি অনেক সময় ‘নির্ভরতায়’ পরিণত হয়। মানুষ যত বেশি অন্যের নির্দেশে কাজ করে, তত বেশি স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা হারায়।

ফলাফল—একটি জাতি ধীরে ধীরে চিন্তা, সৃজনশীলতা ও সাহস হারিয়ে ফেলে। বাংলাদেশে আমরা এখন সেই পথে হাঁটছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর লক্ষাধিক তরুণ গ্র্যাজুয়েট হচ্ছে, কিন্তু তাদের অধিকাংশের লক্ষ্য শুধু চাকরি। নতুন কিছু উদ্ভাবনের, সমাজে পরিবর্তন আনার বা নিজস্ব উদ্যোগ গড়ে তোলার মানসিকতা ক্রমেই বিলীন হচ্ছে।

অর্থনীতির ভাষায় বেকারত্ব বলতে বোঝায়—কর্মক্ষম মানুষ কাজ না পাওয়া। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি শুধু অর্থনৈতিক নয়; এটি এক মানসিকতার সমস্যা। যখন একটি জাতি নিজের হাতে কাজ তৈরি করার বদলে অন্যের হাতে চাকরি খোঁজে, তখন তার মনোবল দুর্বল হয়, আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয় এবং উৎপাদনশীলতাও হ্রাস পায়।

এখন সময় এসেছে সমাজের এ দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর। আমাদের বুঝতে হবে, ব্যবসা-বাণিজ্য কোনো নিম্নতর পেশা নয়—বরং এটি মানবসভ্যতার মূল চালিকাশক্তি। ইসলামী ইতিহাসে দেখা যায়, অধিকাংশ নবী, সাহাবি ও ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন সৎ ব্যবসায়ী। নবী করিম (সা.) নিজেও ছিলেন এক বিশ্বস্ত, ন্যায়নিষ্ঠ ও সৎ ব্যবসায়ী—যিনি তার সততা ও আস্থার কারণে ‘আল-আমিন’ উপাধিতে ভূষিত হন।

অতএব, ব্যবসা শুধু অর্থ উপার্জনের পথ নয়, এটি এক ধরনের ইবাদত, যদি তা ন্যায়, সততা ও মানবকল্যাণের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। আজকের সমাজে আমাদের এই মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। সন্তানদের শেখাতে হবে—‘চাকরি করাও ইবাদত হতে পারে, কিন্তু সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যবসা আরও বড় ইবাদত।’

চাকরিনির্ভর মানসিকতা ভাঙতে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। বর্তমানে আমাদের পাঠ্যক্রমে উদ্যোক্তা শিক্ষা বা কর্মসংস্থান সৃষ্টির চিন্তাধারা প্রায় অনুপস্থিত। বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় কীভাবে পরীক্ষায় ভালো ফল করতে হয়, কিন্তু শেখানো হয় না কীভাবে নিজের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে কাজ তৈরি করা যায়।

প্রয়োজন এমন এক শিক্ষা, যা তরুণদের আত্মনির্ভর, উদ্ভাবনী ও উদ্যোগী করে তুলবে। স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের প্রকল্পভিত্তিক কাজ, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ ও বাস্তব অভিজ্ঞতার সুযোগ দিতে হবে। এজন্য মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘উদ্যোক্তা ক্লাব’ গঠন করতে হবে। একই সঙ্গে পরিবার ও সমাজকেও পরিবর্তন আনতে হবে তাদের প্রত্যাশায়—‘চাকরি নয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি’ হবে নতুন সাফল্যের মাপকাঠি।

ইসলাম মানুষের পরিশ্রম, উদ্যোগ ও আত্মনির্ভরতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। হাদিসে এসেছে—‘ওপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে উত্তম।’ অর্থাৎ, যে দান করে, সে উত্তম; যে গ্রহণ করে, সে নিম্নতর। চাকরির ক্ষেত্রে আমরা অনেক সময় নিচের হাত হয়ে থাকি—অন্যের অনুমতি, অন্যের মর্জি ও অন্যের বেতনের ওপর নির্ভর করি। কিন্তু উদ্যোক্তা হলে, আমরা শুধু নিজেদের নয়, অন্যের জীবিকার ব্যবস্থাও করতে পারি। এটি একদিকে ইবাদত, অন্যদিকে সমাজকল্যাণের পথ।

আমাদের সমাজ এখন এমন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে বেকারত্ব শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়—এটি আমাদের চিন্তা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত মানসিক রোগে পরিণত হয়েছে।

আমাদের মুক্তির পথ তাই একটাই—মানসিকতার পরিবর্তন। আমাদের সন্তানদের শেখাতে হবে, রিজিক আল্লাহর হাতে, কিন্তু উদ্যোগ আমাদের হাতে। যদি আমরা সেই ৯০ শতাংশ রিজিকের পথে—অর্থাৎ, ব্যবসা, উৎপাদন ও সৃজনশীল উদ্যোগের পথে ফিরে যেতে পারি, তাহলে বেকারত্ব শুধু কমবেই না, বরং আমাদের জাতিও আত্মমর্যাদা, স্বাবলম্বী ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হবে।

এখন প্রয়োজন এমন এক প্রজন্ম গড়ে তোলা, যারা চাকরি খোঁজার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে কাজ তৈরি করার মানসিকতা অর্জন করবে। তাহলেই ‘বেকারত্ব’ শব্দটি একদিন ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেবে, বাস্তব জীবনে নয়।

লেখক: অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এফপি/জেএস

সর্বশেষ সংবাদ  
সর্বাধিক পঠিত  
YOU MAY ALSO LIKE  
Editor & Publisher: S. M. Mesbah Uddin
Editorial, News and Commercial Offices: Akram Tower, 15/5, Bijoynagar (9th Floor), Ramna, Dhaka-1000
Call: 01713-180024, 01675-383357 & 01840-000044
E-mail: news@thefinancialpostbd.com, ad@thefinancialpostbd.com, hr@thefinancialpostbd.com
🔝