দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি আজ এমন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে এক দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সহজেই আরেক দেশের নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করতে পারে। বাংলাদেশের ভূ-অবস্থান—ভারত, মিয়ানমার, চীন ও বঙ্গোপসাগর—এই চার দিকের কৌশলগত ঘেরাটোপে—দেশটিকে আঞ্চলিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে। প্রশ্ন উঠছে, এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে?
মিয়ানমার সীমান্তে অনিশ্চয়তা
রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের ফলে সীমান্ত এখন সবচেয়ে নাজুক। গুলিবর্ষণ, মর্টার শেল পড়া, এমনকি সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমারের সেনা ও বেসামরিকদের আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এই পরিস্থিতি কেবল সীমান্ত নয়, বাংলাদেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্যও এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা তৈরি করছে। সীমান্ত অস্থিতিশীলতা যত বাড়বে, শরণার্থী সঙ্কট, চোরাচালান ও সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশের আশঙ্কাও তত বাড়বে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল: অশান্ত প্রতিবেশ
আসাম ও মণিপুরে চলমান জাতিগত সহিংসতা এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর পুনরুত্থান বাংলাদেশ সীমান্তে নতুন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে। সীমান্ত জুড়ে মাদক ও অস্ত্র পাচার, চোরাচালান এবং মানবপাচার বাড়ছে—যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তা সহযোগিতা থাকলেও, উত্তেজনার প্রভাব ঢাকাকে সরাসরি চাপে ফেলে দিতে পারে।
চীন-ভারত প্রতিযোগিতা ও কূটনৈতিক ভারসাম্য
বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ ও ভারতের কৌশলগত স্বার্থ এখন একে অপরের মুখোমুখি। পায়রা বন্দর থেকে রেল নেটওয়ার্ক—প্রায় প্রতিটি অবকাঠামো প্রকল্পেই এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্পষ্ট। ফলে ঢাকা এখন ভারসাম্যের সূক্ষ্ম খেলায় নেমেছে। একদিকে চীনের অর্থনৈতিক সহায়তা, অন্যদিকে ভারতের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা প্রভাব—এই দুই শক্তির টানাপোড়েন দেশটির পররাষ্ট্রনীতিকে আরও জটিল করছে।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অস্থিতিশীলতা
জুলাই ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এখনো সম্পূর্ণ স্থিতিশীল নয়। নতুন ক্ষমতার কাঠামো এবং আন্তর্জাতিক অবস্থান নির্ধারণের প্রক্রিয়া চলছে। এই অনিশ্চয়তা কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই নয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তা কৌশলেও প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো বাংলাদেশে নিজেদের প্রভাব পুনর্গঠন করছে—যা ভবিষ্যতে কূটনৈতিক চাপ বাড়াতে পারে।
বঙ্গোপসাগরে নতুন প্রতিযোগিতা
সামুদ্রিক সীমান্তে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত উপস্থিতি বেড়েছে। বঙ্গোপসাগরের জ্বালানি সম্পদ, নৌ চলাচল ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা এখন বৈশ্বিক স্বার্থের অংশ। বাংলাদেশের জন্য এখানেও ভারসাম্য রক্ষা জরুরি, কারণ নৌপথ নিরাপত্তা ও বিদেশি প্রভাবের সংঘাত যে কোনো সময় নতুন ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
শেষ কথা
বাংলাদেশ সরাসরি কোনো যুদ্ধঝুঁকিতে না থাকলেও, তার চারপাশের অস্থিরতা ও ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেশটিকে “মধ্যম স্তরের আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকি”র মধ্যে ফেলেছে। এখন প্রয়োজন কৌশলগত দূরদর্শিতা, সমন্বিত সীমান্তনীতি, এবং বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় এই তিনটি উপাদানই আগামী দিনের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার নির্ধারক হবে।