আগামীকাল, ১৭ নভেম্বর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক সময়ের অন্যতম মুখ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় রায় ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এই রায় শুধু একজন নেতার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে না—বরং পুরো জাতির রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিপথ নির্ধারণে এক নতুন মাইলফলক হয়ে দাঁড়াতে পারে।
রাজনৈতিক ও ন্যায়ের বিবেচ্য দৃষ্টিকোণ
প্রসিকিউশন পক্ষ বলেছে, জুলাই–আগস্ট আন্দোলনের সময় যে হত্যাকাণ্ড ও গণনিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে, তা শীর্ষ নেতৃত্ব থেকেই পরিকল্পিত ও নির্দেশিত ছিল। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে দায়ের করা মামলায় রায়, যদি দোষসিদ্ধ হয়, তা বাংলাদেশের ন্যায় প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের বিশ্বাসকে এক ধরনের পুনর্বিবেচনায় ঠেলে দিতে পারে। অপরদিকে, আশঙ্কা রয়েছে রায়ের পক্ষপাতিত্ব, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে—প্রতিটি সম্ভাব্য সিদ্ধান্তই দেশকে দুইদিকে ভাগ করতে পারে।
ঢাকায় নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ—উত্তেজনা ও প্রতিক্রিয়া
রায়ের আগের দিন থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে আছে। বিশেষ করে ঢাকায় মোতায়েন করা হয়েছে সেনা, বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই আয়োজন নিঃসন্দেহে কিছুটা সতর্কতা নির্দেশ করে, কিন্তু এটি প্রশ্নও তোলে—কার জন্য নিরাপত্তা এবং কার জন্য চাপ?
একই সময়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটেছে। এরকম নাশকতার ঘটনা রাজধানীর শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর গভীর ছায়া ফেলে এবং সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বাড়ায়।
এদিকে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল নিক্ষেপ করতে এলে গুলির নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। এর আগে চট্টগ্রামে সমান ধরনের গুলির নির্দেশের অভিযোগ ইতিমধ্যেই আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) থেকে উঠেছে। যদি এমন নির্দেশ সত্যিই প্রতিস্থাপিত হয়, তাহলে এটি শাসনের গঠন ও দেশের গনতান্ত্রিক স্বরূপের জন্য একটি মৌলিক বিপদ হয়ে দাঁড়ায়।
জনমনের বিশ্বাস ও ভবিষ্যৎ
সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যেই একটা দ্বৈত মানসিকতা জন্ম নিয়েছে: একদিকে আস্থা, অন্যদিকে ভয়। অনেকেই রায়কে গণ্যবিচার ও প্রতিকারের সুযোগ হিসেবে দেখছেন; আবার অনেকে মনে করছেন, এটি প্রতিহিংসা ন্যায্যতার ছদ্মবেশে।
নিরাপত্তা বাহিনীর ‘বলপ্রয়োগ’ প্রবণতা যদি রায় ঘোষণার প্রেক্ষিতে বাড়ে, তাহলে শুধু রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়বে না—সত্যিকারের অর্থে সামাজিক রূপান্তর ও পুনর্মিলন আরও দূরে সরে যাবে। এমন অবস্থায় সুশাসন, মানবাধিকার এবং আইনি স্থিতিশীলতার সকল ভিত্তিই দুর্বল হতে পারে।
শঙ্কা, দায়িত্ব ও সতর্কতা
রায়ের দিনকে সামনে রেখে, আমাদের প্রত্যেকের জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণ দরকার:
* দায়িত্বশীলতা: সরকার, আদালত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়িত্বশীল এবং স্বচ্ছ হতে হবে।
* সতর্কতা: সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে—তারা আইনগত প্রক্রিয়া সমর্থন করুক, কিন্তু ভয় বা সেখানে সহিংসতা প্রবণতার উত্তরাধিকারীদের আগ্রাসন শিকার হোক না।
* সংলাপ: যাই রায় হোক, ভবিষ্যতের জন্য সংলাপ এবং পুনর্মিলনের পথ তৈরি করা অপরিহার্য—নতুন নিরাপত্তা চুক্তি, রাজনৈতিক সমঝোতাতেই দেশ স্থিতিশীল রূপে এগোতে পারবে।
এই রায় শুধু একজন নেতার বিচার নয়—এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক চিত্রে এক প্রতীকী অধ্যায় হতে পারে। জনমনে উদ্বেগ প্রকৃতই যৌক্তিক, কিন্তু এই উদ্বেগকে সহিংসতা না বরং সংলাপ ও আইনগত পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ হিসেবে রূপান্তর করার দায়িত্ব সবার।
এফপি/এমআই