দেশ স্বাধীনের পর নানা ধরনের প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে, হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাংলাদেশ অনেক নতুন ইতিহাস গড়ে এগিয়েছে। তবে বর্তমান যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কতটুকু অগ্রসর তা সবার কাছে পরিষ্কার। একটি দেশ পরিচালনা এবং দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির জন্য সুস্থধারার রাজনীতি অত্যাবশ্যক। আর যুগে যুগে সেই রাজনীতি তরুণ প্রজন্মের হাতেই পরিচালিত হয়ে এসেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশে তরুণদের রাজনীতি নিয়ে সম্পৃক্ততা দিন দিন শূন্যতায় পরিণত হয়েছে।
ব্রিটিশ কাউন্সিলের ‘নেক্সট জেনারেশন বাংলাদেশ-২০২৪’ গবেষণা সিরিজের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ কমে গেছে। দেশের ৫৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আরও আস্থা আনা প্রয়োজন। জরিপে ৫৫ শতাংশ তরুণ জানিয়ে দিয়েছে তারা পড়াশোনা বা কাজের উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে যেতে ইচ্ছুক। আবার চাকরির সুযোগ কম থাকায়, তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রত্যাশা বেড়েছে। প্রতি ১০ জন তরুণের চারজন (৪৪ শতাংশ) আগামী ৫ বছরের মধ্যে নিজেদের ব্যবসা শুরু করতে চান। যেখানে নাগরিক নেতৃত্বের অভাব দেখা যাচ্ছে, সেখানে মাত্র ১৭ শতাংশ তরুণ নিজেদের কমিউনিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করেন। এই জরিপ থেকে বোঝা যায় যে, দক্ষ মানবসম্পদের ৫৫% যদি দেশ ছেড়ে যেতে চায়, তাহলে তরুণদের দেশ গঠনে সম্পৃক্ত হওয়ার আগ্রহও কমে যাচ্ছে। সিপিডির এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে ৩৫.৪% তরুণ দেশের নেতৃত্ব নিতে আগ্রহী। তবে নীতি পরিবর্তন হলেই কেবল ৪৬.৬% তরুণ নেতৃত্বে অংশ নিতে চান। বিষয়টি কেবল আগ্রহ বা ইচ্ছা পোষণ করা নয়, বাস্তবে তরুণদের সম্পৃক্ততা অনেক কম।
আজকের আলোচনার বিষয় হলো, তরুণদের রাজনীতি সচেতনতা এবং তাদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার অবস্থা। নেতৃত্ব গড়ে ওঠার যে ইতিহাস আমরা দেখেছি, তাতে পূর্বের নেতৃত্বে গঠর প্রকৃয়া আর বর্তমান নেতৃত্ব গঠনে অনেক পরিবর্তন। ইতিহাসে আমরা দেখি, দেশ গঠনে যারা আগে এগিয়ে এসেছিলেন, তাদের একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছিল। তাদের নেতৃত্বের গুণাবলীর মধ্যে দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, মানবতা, উন্নয়নবোধ, শিক্ষা এবং নীতি- নৈতিকতার পরিলক্ষণ ছিল। তারা কখনো নিজেদের নীতির সঙ্গে আপোষ করতেন না। মসনদের লোভ-লালসা কম ছিল। রাজনীতিকে তারা আয়ের ক্ষেত্র হিসেবে দেখতেন না। মাঠ থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত, তারা তাদের ভিশন বাস্তবায়নে কঠোর পরিশ্রম করতেন এবং জনউন্নয়নমূলক বিভিন্ন কাজ করে জনপ্রিয়তা অর্জন করতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই ধরনের নেতা হারিয়ে যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম জ্ঞান-বিজ্ঞানে এবং পেশায় যতটা এগিয়েছে, রাজনীতিতে তাদের অস্তিত্ব ততটা পজিটিভ দেখা যাচ্ছে না। যাদের দেখা যাচ্ছে, তাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বিব্রতকর। বর্তমান জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো কি তাদের তরুণ কর্মীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে? যেমন: আমরা দেখতে পাই, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক দলের কর্মী হয়ে ওঠে। কলেজে উঠে তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা হয়। এই তরুণ নেতার পেছনে থাকে অনেক কর্মী এবং বড় রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন। তবে মাধ্যমিক স্কুল শেষ না করেই রাজনীতিতে সক্রিয় হতে তার কোনো বাধা নেই। আঠারো বছর বয়স হওয়ার আগেই সে নেতা হয়ে যায়। একটি ছেলে এত কম বয়সে পড়াশোনা বাদ দিয়ে বড় নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখে, অথচ নেতা হওয়ার জন্য যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করার কথা, তার ধারেকাছেও যায় না। সে মনে করে, আর একটু এগিয়ে গেলে টাকা আয়ের সুযোগ আসবে। এসএসসি শেষ না করেও, সে ইউনিয়ন কমিটিতে বা উপজেলা কমিটিতে স্থান করে নেয়। যারা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়, তারা পূর্বের অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন কমিটিতে যোগদান করে। সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি ও খুন-খারাবিতে হাত পাকিয়ে, বড় নেতার বিশ্বস্ত ডান হাত হয়ে ওঠে। রাজনীতি নিয়ে সীমাহীন ব্যস্ততার মাঝে, পড়াশোনা করা অনেক সময় তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে! রাজনৈতিক পারফরম্যান্স ভাল হলে, ছাত্র নেতা দ্রুত উপরে উঠে যায়। যে বয়সে তাকে পড়াশোনা ও দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানার কথা, সে বয়সে তাকে অপরাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে হয়। আমাদের দেশে রাজনীতিতে কালো টাকার এক বিশাল প্রভাব রয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতিবছর এই প্রক্রিয়ায় প্রবাহিত হয়। বড় নেতারা এসব কালো টাকার একটি বড় অংশ নিজেদের আখের গোছানোর জন্য ছাত্র নেতাদের পেছনে খরচ করেন। মোটরসাইকেল, গাড়ি কিনে উপহার দেন, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেন, বিভিন্ন অপকর্মের মামলাগুলো থেকে রক্ষা করেন। অপরিপক্ক রাজনৈতিক নেতা হওয়ার ফলে দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, আইনের শাসনের অভাব, আইনকে কেউ ভয় করে না এবং রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্থ।
আমাদের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকদের কাছে কিছু প্রশ্ন:
১. গ্রামের/পাড়ার সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটি কী রাজনীতিতে সক্রিয়?
২. নিরিবিলি, ভদ্র ও এলাকায় ভাল ছেলে কী সক্রিয় রাজনীতি করে?
৩. রাজনীতি নিয়ে এসব ছেলেদের মূল্যায়ন কী পজিটিভ?
৪. রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন কমিটিতে যারা স্থান পায়, তাদেরকে কি সমাজের মানুষ ভাল ছেলে, ভাল ছাত্র হিসেবে মনে করে?
৫. বড় রাজনৈতিক নেতাদেরকে মানুষ সত্যি সত্যি সম্মান করে?
৬. রাজনীতির নামে সন্ত্রাস, পিকেটিং ও টেন্ডারবাজিকে মানুষ পছন্দ করে?
৭. তরুন বা ছাত্র নেতাদের সঠিক মূল্যায়ন এবং প্রশিক্ষনের কি ব্যবস্থা রয়েছে?
যদি সব প্রশ্নের উত্তর ‘না’ হয়, তাহলে এটি স্পষ্ট যে, ‘রাজনীতি তথা নেতৃত্ব তৈরির সংস্কার প্রয়োজন।’ আমাদের দেশের তরুণরা বর্তমানে পাওয়ার পলিটিক্সের শিকার। পৃথিবীর কোন নেতা বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। তবে, পিছন ফিরে তাকিয়ে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করলে দেশ এগিয়ে যাবে না। স্বৈরাচারী হাসিনার দেখানো রাজনীতির পথে হাঁটলে সামনে আরো বিপদ অপেক্ষা করছে। আমরা তরুণ প্রজন্ম বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশ যখন জন্ম নিয়েছিল, তখন এটি একটি অসুস্থ শিশুর মতো ছিল। ১৯৭১-এর পর বহির্বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের শত্রুতা, ভারতের আগ্রাসন আমাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি। অনেক প্রতিকূলতার মাঝে, আজ বাংলাদেশ সুস্থ কিশোর থেকে যৌবনে পা রেখেছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বিপ্লব এবং গণঅভূথান প্রমাণ করে, যে তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিকে অপছন্দ করছিল, সেই তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশ এবং এ দেশের প্রতিটি মানুষকে কতটা ভালোবাসে। তাদের দেশপ্রেম এবং ভালোবাসা সত্যিই প্রসংশার দাবিদার।
এমনকি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আজকাল এমন নেতৃত্বের উদাহরণ দেখা যায় যে শুধু নিজেদের পড়াশোনা এবং ব্যক্তিগত উন্নতিতে সীমাবদ্ধ নয়, তারা সামাজিক, মানবাধিকার রক্ষায়, পরিবেশ সংরক্ষণে ও সাংস্কৃতিক তথা সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে নিজেদের প্রতিভা এবং কর্তব্যবোধের পরিচয় দিচ্ছে পাশাপাশি তাদের ক্যারিয়ার গড়ছে আন্তর্যাতিক পর্যায়ে।
বেসরকারী ২০২৪ এর জুলাই-আগষ্ট স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অগ্রনী ভুমিকা ও আত্মত্যাগ সত্যিই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে অবাক করেছে এবং গনআন্দোলনে রূপনেওয়ার প্রেষনা দিয়েছে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাঠে না নামলে হয়তবা আজকের স্বৈরাচারমুক্ত নতুন বাংলাদেশ দেখা সম্ভব হত না। প্রশ্ন হচ্ছে এই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাজাতীয় রাজনীতিতে কতটুকু অংশগ্রন করতে ইচ্ছুক?
দেশের অনেক বড় নেতার মুখস্থ করা কিছু বুলি আমাদের তরুনদের কোন আশার আলো দেখায় না বরং আশাহত করে। এখন দেশকে ভালবাসার সময় এবং দেশের জন্য কাজ করার সময়। পুরোনো ইতিহাস ঠিকই জানে তরুনরা। তাই বলে পিছন ফিরে উলটা হাটতে রাজি নয় তারা। দেশের মেধাবী প্রজন্ম যেখানে হাত দিয়েছে সেখানে সোনা ফলেছে। সফটওয়্যার শিল্প, ঔষধ শিল্প, গার্মেন্টস শিল্প , রেমিটেন্স প্রবাহ , বহির বিশ্বে অধ্যায়নরত ছাত্রদের ক্যারিয়ার, এই সেক্টর গুলো দেশের নাম উজ্জ্বল করেছে । তাহলে রাজনীতিতে মেধাবীদের স্থান দেয়া হচ্ছে না কেন? তবে কি আমাদের রাজনীতিবিদরা ভীরু । রাজনীতিতে জ্ঞানের চর্চা এত কম কেন । নতুনদের গ্রহন করার ক্ষমতা এত কম কেন আমাদের রাজনীতিবিদদের । অন্য কে নিয়ে যতটা না ভাবে এই বুড়োর দল তার থেকেও অনেক কম ভাবে নিজের আদর্শগত অবস্থান নিয়ে। একটি গ্রুপের হতে কেন নেতৃত্ব জিম্মি থাকবে? এইসব প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর খুঁজে না পেয়ে, (British Council এর NEXT GENERATION প্রকাশনাতে দেখা গেছে) ৭৪% তরুণের রাজনীতি বিমুখতা। আমরা তরুণ প্রজন্ম যদি এইসব প্রশ্নের উত্তর পাই, তবে আমরা রাজনীতিতে প্রবেশ করব, মেধাবী মানুষে ভরে উঠবে রাজনৈতিক অঙ্গন এবং দেশের জন্য সোনা তো ফলাবোই। বাংলাদেশের প্রায় ১৮কোটি জনগনের জন্য ৪৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে, যার মধ্যে জনপ্রিয়তায় শীর্ষে রয়েছে ৪টি দল। ৪টি দলের মধ্যে গণঅভ্যুত্থানে মৃতপ্রায় একটি, অন্যএকটি বলতেগেলে লাইফ সাপোর্টে। বাকি ৪৫টি দলের অবস্থাতো আমরা দেখতেই পাচ্ছি, এ মুহূর্তে নতুন প্রজন্মের দলগুলি শীর্ষ রাজনৈতিক দলের কাতারে জায়গা করে নিতে চায়। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত, সনাতন ধারনা থেকে বের হয়ে তরুণদের সম্পৃক্ত করে, একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করা। নতুনভাবে রাজনৈতিক দলের সংস্কার প্রয়োজন। তাদের নেতৃত্ব তৈরিতে কৌশলী হতে হবে, তরুণদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, সাকসেশন প্লানিং করতে হবে, যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচনী প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে হবে, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত মূল্যায়ন ব্যবস্থা করতে হবে, গবেষণামূলক দক্ষতার ভিত্তিতে বিশেষ সেল তৈরি করতে হবে, নতুন সেক্টরে নেতৃত্ব গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে তা কার্যকর করতে হবে, মেধাভিত্তিক নেতৃ্ত্ব কাঠামো তৈরী করতে হবে, দেশের সামাজিক কাজে নতুন নেতৃত্বের সম্পৃক্ত করতে হবে, আন্তর্যাতিক রাজনীতির বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষন প্রদান করতে হবে। গনতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়, এবং রাষ্ট্র পরিচালনা করে সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়তে সুস্থধারার মেধাভিত্তিক রাজনীতির বিকল্প নেই। তাই রাষ্ট্র পরিচালনা এবং দেশকে বিশ্বের বুকে রোল মডেল হিসেবে তৈরী করতে মেধাভিত্তিক তরুন নেতৃত্বের বিকল্প নেই। আর তরুনদের রাজনীতিতে অংশগ্রহন করানোর জন্য রাজনৈতিক দল সমূহের সেই পরিবেশ তৈরী করতে হবে। তাহলেই আমারা একটি সুন্দর, সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলাদেশ দেখতে পারব।
লেখক: শাহ্নাজিমউদ্দিন (মুনান)।
এফপি/এমআই