মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিধন্য জন্মস্থান সাগরদাঁড়ি যেন প্রকৃতির অবহেলায় এক মহাবিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়েছে। যশোরের কেশবপুর উপজেলার এই ঐতিহাসিক জনপদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের একমাত্র পথ কপোতাক্ষ নদের উপর বাঁশের সাঁকো সম্প্রতি ভেঙে পড়ে যাতায়াতে নেমে আসে দুর্ভোগের করাল ছায়া।
সম্প্রতি অতিবর্ষণ ও কচুরিপনার চাপে সাঁকোটি ভেঙে পড়ে কপোতাক্ষে বিলীন হয়ে যায়। এতে করে কেশবপুর ও তালা উপজেলার মধ্যকার সাগরদাঁড়ি, শেখপুরা, রেজাকাটি, বগা, মহাদেবপুর, সারসা, সরুলিয়া, সেনেরগাতি, ধানদিয়াসহ প্রায় ২৫টি গ্রামের মানুষের চলাচল একেবারে বন্ধ হয়ে পড়ে। বিশেষত শিক্ষার্থী, কৃষক, ব্যবসায়ী এবং পর্যটকদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও পর্যটন সম্ভাবনায় ভরপুর সাগরদাঁড়ি শুধু মহাকবির জন্মস্থান নয়, এটি আজও হাজারো মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক প্রান্তিক জনপদ। এখানকার কলেজ, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে যাতায়াত করত। হাটবারে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ধান, শাকসবজি, কলা, মিষ্টি কুমড়া প্রভৃতি বিক্রি করতে আসত সাগরদাঁড়ির হাটে। স্থানীয় কৃষক সাজ্জাত আলী জানান, নদীতে হঠাৎ পানি বাড়ায় স্র্রেতের গতি বেড়ে যায়। উজান থেকে নেমে আসা কচুরিপনা আর শ্যাওলার চাপে সাঁকোটি হঠাৎ ভেঙে পড়ে। এখন নৌকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। সাগরদাঁড়ি বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাজ্জাক আহমেদ রাজু বলেন, এ বছরের শুরুতে মধুকবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সাঁকোটি স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে যে বাঁশের কাঠামো নির্মাণ করা হয়, তা কতটা টিকবে? শ্যাওলা জমে সাঁকোর নিচে বাধা সৃষ্টি করে, এরপর ধীরে ধীরে সেটি ভেঙে পড়ে।
এই বাঁশের সাঁকোটি বিগত পাঁচ দশক ধরে এলাকাবাসীর জীবনধারার অংশ হয়ে ওঠে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মাঝেমধ্যেই এটি ভেঙে পড়ে। ভাঙে জনদুর্ভোগ, থেমে যায় শিক্ষার্থী, নারী, কৃষক ও রোগীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি একটি পাকা সেতু আজও রয়ে গেছে কেবলই আশ্বাস আর নথিপত্রে সীমাবদ্ধ। সাগরদাঁড়ি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আকরাম হোসেন জানান, উপজেলা প্রকৌশলী দফতরের মাধ্যমে এই স্থানে সেতু নির্মাণের কারিগরি প্রতিবেদন ও ম্যাপ প্রস্তুত করে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
কবিতায় কপোতাক্ষ ছিল মহাকবির আত্মার নদী,কপোতাক্ষ তুমি আমার কবিতার উৎস, তোমার শান্ত ধারা আমার হৃদয় জুড়ে। কিন্তু বাস্তবে কপোতাক্ষ যেন এখন এই অঞ্চলের জনজীবনের বিঘ্ন ঘটানো এক প্রতিবন্ধকতায় পরিণত হয়েছে। মহাকবির জন্মভূমিতে এমন একটি জরাজীর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থা যেন পুরো জাতির জন্যই লজ্জার বিষয়।
কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেকসোনা খাতুন সাঁকো ভেঙে পড়ার ঘটনা তদন্ত করতে সরেজমিন পরিদর্শনে যান। তিনি বলেন, কচুরিপনা জমে সাঁকোটি ভেঙে পড়েছে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। সাঁকোর অবশিষ্ট অংশ মেরামতের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে স্থায়ী সমাধানের বিষয়ে প্রশাসনের অবস্থান স্পষ্ট নয়। এলাকাবাসী প্রশ্ন তুলেছে, কেন ৫০ বছরেও একটি পাকা সেতু নির্মাণ করা গেল না?
সাগরদাঁড়ি কেবল একটি জনপদ নয়; এটি জাতীয় পর্যটন সম্ভাবনার একটি বড় অংশ। মহাকবির বাড়ি, স্মৃতি রক্ষা কেন্দ্র, মিউজিয়াম, কপোতাক্ষ নদের সৌন্দর্য এবং গ্রামীণ সংস্কৃৃতি মিলিয়ে এখানে গড়ে তোলা যেতে পারে পর্যটনমুখী এক আদর্শ জনপদ।
প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা থেকে আগত পর্যটকরা বাধ্য হচ্ছে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতে। এতে একদিকে যেমন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয় দুর্বিষহ, অন্যদিকে স্থানীয় অর্থনীতিও সংকুচিত হচ্ছে।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা আর কোনো অস্থায়ী সমাধান চান না। তারা চান, একবারেই স্থায়ী, টেকসই, নিরাপদ একটি সেতু। সাগরদাঁড়ি বাজার কমিটির সদস্য মোবারক আলী বলেন, আমরা কেবল ভোটের সময় আশ্বাস পাই। তারপরে সব ভুলে যায়। যদি মধুসূদনের সাগরদাঁড়ি হয়েও উন্নয়ন না হয়, তাহলে দেশের আর কোথায় হবে ?
স্মৃতিবিজড়িত জনপদে যদি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা না থাকে, তবে কেবল ইতিহাস দিয়ে কি বর্তমানকে টেনে রাখা সম্ভব? সেতু নির্মাণের এই দীর্ঘ অপেক্ষা যেন একটি জাতির আত্মসম্মানকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। এখন সময় এসেছে প্রশাসনের, স্থানীয় সরকার, জনপ্রতিনিধি ও প্রকৌশল দফতরের সম্মিলিত উদ্যোগে একটি স্থায়ী সেতু নির্মাণের। তা না হলে মধুসূদনের সেই কবিতার নদী কপোতাক্ষ আর কবিতার নদী থাকবে না থাকবে কেবল জনদুর্ভোগের প্রতীক হিসেবে।
এফপি/রাজ