বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চকে কেবল ইতিহাসের পাতায় বন্দী করে রাখার সুযোগ নেই। জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখল কোনো বিচ্ছিন্ন সামরিক ঘটনা ছিল না; এটি ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতার সরাসরি ফল। আজ যখন আবারও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, নির্বাচনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক আস্থার প্রশ্ন উঠছে, তখন এরশাদের উত্থান নতুন করে আমাদের সামনে একটি অস্বস্তিকর প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।
জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের সরকার সাংবিধানিক বৈধতা পেলেও কার্যকর রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে পারেনি। প্রশাসনিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক বিভাজন এবং সিদ্ধান্তহীনতা রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে তোলে। সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছিল সামরিক শক্তি। ইতিহাসের নির্মম সত্য হলো—গণতন্ত্র যখন নিজের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়, তখন অন্য শক্তি তা দখল করে নেয়।
আজকের বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা হয়তো সরাসরি নেই, কিন্তু গণতান্ত্রিক সংকটের লক্ষণগুলো স্পষ্ট। নির্বাচনব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন, বিরোধী রাজনীতির কার্যকর ভূমিকার সংকোচন, প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব এবং মতপ্রকাশের পরিসর সংকুচিত হওয়ার অভিযোগ—এসবই সেই পরিচিত দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়, যা একসময় এরশাদের উত্থানকে ত্বরান্বিত করেছিল।
এরশাদের শাসন দেখিয়েছে, বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল শুধু সংবিধান স্থগিত করে না; এটি নাগরিকদের ধীরে ধীরে নীরব করে দেয়। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যখন আইন, প্রশাসন বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জনগণের জবাবদিহিতার বাইরে চলে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে, তখন সেই অভিজ্ঞতা আমাদের সতর্ক বার্তা দেয়। গণতন্ত্র কেবল নির্বাচন নয়—এটি হলো ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ এবং নাগরিক অধিকার রক্ষার একটি কাঠামো। সেই কাঠামো দুর্বল হলে রাষ্ট্র শক্তিশালী দেখালেও ভিতরে ভিতরে ফাঁপা হয়ে পড়ে।
এরশাদ ক্ষমতায় টিকে থাকতে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন ও রাজনৈতিক কাঠামোর আশ্রয় নিয়েছিলেন। আজও যখন অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ, তখন ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের অস্বস্তিকর মিল চোখে পড়ে। ক্ষমতার বৈধতা যদি জনগণের সম্মতির বদলে প্রশাসনিক কৌশল ও শক্তির ভারসাম্যের ওপর দাঁড়ায়, তবে তা গণতন্ত্র নয়—তা কেবল দীর্ঘস্থায়ী সংকটের রূপরেখা।
১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান আমাদের আরেকটি শিক্ষা দেয়, যা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। জনগণ দীর্ঘদিন চুপ থাকলেও তারা ভুলে যায় না। ছাত্রসমাজ, পেশাজীবী ও রাজনৈতিক শক্তির সম্মিলিত আন্দোলন প্রমাণ করেছিল—শক্তির জোরে টিকে থাকা কোনো শাসন শেষ পর্যন্ত জনগণের রায়ের কাছেই পরাজিত হয়। এই শিক্ষা আজকের শাসক ও বিরোধী—উভয়ের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য।
আজকের বাস্তবতায় প্রশ্নটি তাই আরও তীব্র: আমরা কি প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করব, না কি আবারও ব্যক্তি ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির পথে হাঁটব? আমরা কি বিরোধী কণ্ঠকে শত্রু হিসেবে দেখব, নাকি গণতন্ত্রের অপরিহার্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করব?
এরশাদের উত্থান আমাদের শেখায়—গণতন্ত্র একদিনে ধ্বংস হয় না, ধাপে ধাপে দুর্বল হয়। আর সেই দুর্বলতার সুযোগেই ক্ষমতা বন্দুক, নির্দেশ বা নিয়ন্ত্রণের ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। ইতিহাস আমাদের সতর্ক করেছে। এখন দেখার বিষয়, আমরা শিক্ষা নেব—নাকি আবারও একই ভুলের দিকে এগোব।
মুহাইমিনুল ইসলাম— লেখক ও সাংবাদিক