দেড় মাসের টানা আন্দোলন ও শাটডাউনের পর এখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) শুরু হয়েছে প্রশাসনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। বাধ্যতামূলক অবসর, বরখাস্ত, বদলি এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানের কারণে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চরম অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
গত রোববার রাতে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হলেও এরপর থেকেই এনবিআরের একাধিক স্তরের কর্মকর্তা শাস্তির মুখোমুখি হচ্ছেন। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় থাকা অনেক আন্দোলনকারী নিজেদের অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছেন। অনেকে অফিসে গেলেও কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না।
দুদক গত পাঁচ দিনে এনবিআরের ১৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। তাঁদের মধ্যে দুজন এনবিআর সদস্য এবং কয়েকজন কমিশনার রয়েছেন। বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কমিশনার মো. কামারুজ্জামান, ঢাকা পূর্ব কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কাজী মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিনসহ পাঁচজনের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে।
ইতোমধ্যে তিনজন সদস্য ও একজন কমিশনারকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। বরখাস্ত হয়েছেন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার জাকির হোসেন। জানা গেছে, আন্দোলন চলাকালে তিনি কর্মবিরতিতে অংশ নেন এবং ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলেন।
আন্দোলন প্রত্যাহারের আগে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। এই আশ্বাসে মধ্যস্থতা করেন কয়েকজন শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা। তাঁদের একজন, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, “আমরা স্পষ্টভাবে জেনেছিলাম, শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হবে না। কিন্তু এখন সেই আশ্বাসের ব্যত্যয় ঘটেছে।”
আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন ওই ব্যবসায়ী নেতাদের কাছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বন্ধের দাবিতে যোগাযোগ করছেন।
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, আন্দোলনে জড়িত ছিলেন এমন আরও অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। বাধ্যতামূলক অবসর, বদলি ও তদন্তের আওতায় আনার জন্য পৃথক তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
নজরে আছেন বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, যাঁরা সামাজিক মাধ্যমে বা প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেছেন, “ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।” তিনি বদলি ও অবসরের বিষয়ে বলেন, “এসব সরকার নির্ধারিত নীতিগত সিদ্ধান্ত। এখানে আমার কিছু বলার সুযোগ নেই।”
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গত রোববার বলেন, “ভয়ডরহীনভাবে কাজ করুন।” কিন্তু মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। তদন্ত ও শাস্তির খবরে এখন পুরো এনবিআরে এক ধরনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ বিরাজ করছে।
এনবিআর সংস্কারের দাবিতে গত মে থেকে আন্দোলনে নামে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দাবি ছিল, এনবিআর ভেঙে দুটি আলাদা বিভাগ- রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব প্রশাসন- তৈরি হলে তা যেন সবাইকে নিয়ে যৌক্তিকভাবে করা হয়।
দেড় মাস চলা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে দেশব্যাপী রাজস্ব আদায় বন্ধ করে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করেন তাঁরা। এতে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। এরপর সরকারপক্ষ ও ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যস্থতায় আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “যেহেতু একটি সমঝোতা হয়েছিল, তাই এত দ্রুত শাস্তিমূলক পদক্ষেপ না নিয়ে অপেক্ষা করা যেত। এতে আতঙ্ক সৃষ্টি হতো না।”
অস্থিরতা ও আতঙ্ক কাটিয়ে এনবিআরে স্বাভাবিকতা ফেরাতে কর্মীদের মধ্যে আস্থার পরিবেশ তৈরির তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সরকারি মহলে কড়াকড়ি ও শৃঙ্খলার বার্তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এফপি/রাজ