কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ, সরকারি বনভূমিতে অনুমতি ছাড়া লাইন স্থাপন, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হাতির মৃত্যু এবং দালালদের সক্রিয় ভূমিকা স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
উখিয়ার বনে প্রায় দেড় হাজারের অধিক অবৈধ বৈদ্যুতিক মিটার দিয়েছে কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ অফিস। বনের জায়গায় বিদ্যুতের মিটার দেওয়া আইনগত নিষেধ থাকলেও কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ অফিস উখিয়া শাখা তা তোয়াক্কা না করে এসব মিটার দিয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়েছে।
বনে বিদ্যুৎ থাকার কারণে দেশের মধ্যে সব চাইতে বেশি হাতি মারা গেছে উখিয়া উপজেলায়। তার পরেও পল্লী বিদ্যুতের কোনো ধরনের মাথাব্যথা নেই এসব নিয়ে। যার কারণে উখিয়া উপজেলায় বন্যপ্রাণী প্রায় বিলুপ্তির পথে বলা চলে।
এদিকে বিদ্যুৎতের মিটার নিতে লাগে জাতীয় পরিচয় পত্র, যে জায়গায় বিদ্যুৎ নেওয়া হবে সেই জায়গার খতিয়ানসহ বেশ কিছু কাগজপত্র। এসব কাগজপত্র নিয়ে আবেদন করতে হয় বিদ্যুৎ অফিসে। এরপর বিদ্যুৎ অফিস থেকে সরেজমিনে তদন্ত করে সবকিছু ঠিকটাক থাকলে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ মিটার।
কিন্তু উখিয়া উপজেলায় ঘটেছে ভিন্ন চিত্র। কোটি কোটি টাকা খরচ করে অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীরা বনের জায়গায় বৈদ্যুতিক মিটার নিয়েছে বলে মনে করছে স্থানীয়রা। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা স্থানীয় বনবিভাগের বিশাল জায়গা দখল করে তাদের ক্যাম্প তৈরি করে আজ অবধি বসবাস করে আসছে। তাদের কোনো জাতীয় পরিচয়পত্র, জায়গার খতিয়ান না থাকলেও তাদের বাড়ি ও দোকানপাটে জ্বলছে বৈদ্যুৎতিক বাল্ব। স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের অনিয়মের মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার বিদ্যুৎ মিটার প্রদান করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের অধিনে উখিয়া রেঞ্জে বনবিভাগের জায়গায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প গড়ে উঠেছে। বনের জায়গায় কোনো ধরনের বৈদ্যুতিক মিটার দেওয়ার অনুমতি না থাকলেও উখিয়া পল্লী বিদ্যুৎ অফিস নিয়মের তোয়াক্কা না করে উখিয়ারঘাট এলাকার আরএস ১৭০ দাগে হরিনমারা এলাকায় ক্যাম্প ৮(ই) তে ১৫০টি ক্যাম্প ১৩-তে ৮৩৬টি, ক্যাম্প ১৯-এ ৫৬৭টি- এই তিন জায়গায় মোট ১৫৫৩টি আবাসিক ও বাণিজ্যিক বৈদ্যুতিক মিটার প্রদান করে পল্লী বিদ্যুৎ অফিস উখিয়া শাখা। এই অবৈধ বিদ্যুৎ মিটার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে উখিয়া রেঞ্জ অফিস থেকে গত ১৪ সেপ্টেম্বর চিঠি প্রদান করা হলে উল্টো বনবিভাগকে শর্ত দেন পল্লী বিদ্যুৎ অফিস উখিয়া শাখা।
উখিয়া পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের ডিজিএম কাইছার নুর এক চিঠিতে বনবিভাগকে জানান, ক্যাম্পে ১৫৫৩টি আবাসিক এবং বাণিজ্যিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য তালিকা প্রদান করেন। বন বিভাগের প্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধি এবং উল্লেখিত সিআইসি অফিসের প্রতিনিধি গণের সমন্বয়ে যৌথ টিমের সঙ্গে ওই অফিস তালিকা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সংযোগসমূহ বিচ্ছিন্ন করতে আগ্রহী বলে জানান চিঠিতে। বন বিভাগের প্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধি এবং উল্লেখিত সিআইসি অফিসের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে তারিখ নির্ধারণ করে ওই অফিসকে অবগত করার জন্য বনবিভাগকে অনুরোধ করেন।
তবে স্থানীয় সচেতন মহল বলছে, টাকার বিনিময়ে বনের জায়গায় এসব মিটার প্রদান করা হয়েছে। বনে জায়গায় মিটার দেওয়ার সময় বনবিভাগকে দরকার পড়েনি। কিন্তু যখনই বনের জায়গা থেকে বৈদ্যুতিক মিটার সরানোর জন্য বলা হয়েছে তখনই বিভিন্ন অজুহাত দেখাচ্ছে পল্লী বিদ্যুৎ অফিস। গত ১৮ সেপ্টেম্বর উখিয়া বন রেঞ্জের সদর বনবিটের জুমছড়ি এলাকার গহিন বনাঞ্চলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বন্যহাতির মৃত্যু হয়। এরসঙ্গে জড়িত জুমছড়ি এলাকার মৃত আব্দুল্লাহর ছেলে আবু তাহের প্রকাশ তাহের মিয়া বলে জানা যায়। হাতি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ধামাচাপা ও মামলা থেকে ধামাচাপা দিতে লাখ টাকার মিশন হাতে বন প্রশাসনের ধারে ধারে গিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
এই অনিয়মের সঙ্গে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) কাইজার নূরের সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে গত কয়েকদিন ফোন করা হলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয়দের দাবি, তিনি ও তার ঘনিষ্ঠ দালাল আজাদ সিন্ডিকেট নিয়ে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে অবৈধ সংযোগ দিয়ে আসছেন।
বন বিভাগের তথ্যমতে, সরকারি বনভূমিতে অনুমতি ছাড়াই ইতোমধ্যে ২ হাজারের বেশি অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। উপজেলার হরিণমারা, দৌছড়ি, মধুরছড়া, থাইংখালী, পালংখালী মরিচ্যা ও রত্নাপালং-এ গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অন্তত ছয়টি বন্য হাতি মারা গেছে, যার মধ্যে চলতি বছরেই দুটি হাতির মৃত্যু হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, অবৈধ সংযোগের কারণে বারবার বিপর্যয় ঘটছে ৩৩ কেভি বিদ্যুৎ লাইনে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে ৩০ বার ফল্ট হয়েছে। এতে প্রতিদিন গড়ে ৮-১০ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন থাকছে উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির তত্ত্বাবধানে গত দেড় বছরে বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এই তালিকায় রয়েছে সরকারি দপ্তর, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রভাবশালীদের নাম। যাদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নতুন সংযোগ নিতে গিয়ে ভোগান্তির শিকারও হচ্ছেন সাধারণ গ্রাহকরা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা কক্সবাজার অঞ্চল সভাপতি এইচএম এরশাদ জানান, বনের জায়গায় কিভাবে বৈদ্যুতিক মিটার প্রদান করে? মিটার নেওয়ার কিছু শর্ত আছে সরকারিভাবে। যারা বিদ্যুৎ মিটার নিয়েছে বনের জায়গায় তা অনৈতিকভাবে নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
টেকনাফ ও উখিয়ার দায়িত্বরত সহকারি বন সংরক্ষক মো.মনিরুল ইসলাম জানান, বনের জায়গায় বৈদ্যুতিক মিটার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। পল্লী বিদ্যুৎকে চিঠি প্রদান করা হয়েছে। আরো কিছু কাজ বাকি আছে, তা শেষ করে আমরা যৌথ অভিযানের মাধ্যমে সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ শুরু করবো।
কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের জেনারেল ম্যানেজার মকবুল আলমের সঙ্গে কথা হলে তিনি প্রতিবেদককে লিখিত দেওয়ার জন্য বলেন এবং এরপর তিনি বিস্তারিত জানাবেন বলে জানান।
উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান জানান, পল্লী বিদ্যুৎ অফিসকে বনের জায়গা থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য চিঠি প্রদান করা হয়েছে বনবিভাগ থেকে। কিন্তু নানান অজুহাতে তা এড়িয়ে যাচ্ছে তারা।
এদিকে বিগত দিনে উখিয়ার সংরক্ষিত বনাঞ্চলে অবৈধ সংযোগ দিতে গিয়ে বনবিভাগের হাতে আটক হয়েছিলো ৪ পল্লী বিদ্যুৎ কর্মী। রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও একই অবৈধ সংযোগ দিয়ে অর্থ লেনদেনের প্রমাণ মিলেছে। লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খোরশেদ নামে এক তথাকথিত ইলেকট্রেশিয়ানের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকার মাধ্যমে অবৈধ সংযোগ নেন সেখানকার এক বাসিন্দা। নিবন্ধিত ৭ ইলেকট্রিশিয়ান থাকলেও খোরশেদ, ইমাম, সালাউদ্দিন, জসিমের মতো প্রায় ৪০ জন ইলেকট্রিশিয়ান নামধারী একটি চক্র জড়িত এসব অপকর্মে, সিন্ডিকেট বানিয়ে যাদের নিয়ন্ত্রণ করেন ওয়ারিং ইন্সপেক্টর গোপাল।
অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ থেকে বড় কমিশন দেয় দালালেরা। অভিযোগ আছে, গোপাল নিজের অংশ রেখে ভাগ পৌঁছান অন্য কর্তাদের পকেটে।
এফপি/অ