একজন ভদ্রলোকের জন্য
শুনুন, অনেক বলেছেন, আর কতো! এবার রাখুন।
না হলে ভাঙবে বৈশাখের ঝড়ে ঘরবাড়ি, বুঝলেন কিছু!
নিজেকে তুলসিধোয়া পানি ভাবছেন!
বলুন তো কোন হাওয়ায় উড়ছেন দিবানিশি?
রঙিন বেলুন উড়ছে আকাশে
মেঘলা আকাশে রঙধনু ক্ষণিক মুহূর্ত
নিজেও তো উড়ছেন সাধের মনঘড়িতে ষোলোআনা
বেশ তো আছেন বেহায়া সুন্দর আনন্দে, থাকুন।
অযথা চাবুক পেটাচ্ছেন হারানো প্রেমের প্রতিশোধে,
কথার কারুতে দারুণ আপনি-নকশিতে
এফোড় ওফোড় পৈত্রিক জমিন, কী আশ্চর্য!
গভীর আবেগে বুকে মাখেন গৌরীর কাদামাটি!
আপনি দারুণ আঁকতে পারেন স্বর্গের নিখুঁত ছবি
মুগ্ধতায় ডুবে থাকে ভবিষ্যৎহীন সরল কৃষক
তারপর অনেক তো হলো—এবার শুনুন—
সোজা হেঁটে যান ছেড়ে অনেক কষ্টের কাদামাটি ঘর।
বাঁশি বাজবে সন্ধ্যার—জোনাকীরা জ্বলবে গ্রামনগর
বাজবে মৌতাত লালন হাছন একতারা—
অযথা আপনি বসে আছেন ওৎপাতা চতুর শৃগাল
গভীর রাতের অপেক্ষায়—
স্বর্গকন্যা
পদ্মায় মাতাল ঝড়—কখন আসবে বলো স্বর্গকন্যা
মেঘ থেকে সব সাদা রঙ
এনে তোমাকে বানাবো আজ ঘুমহীন সাধনায়
শরতের সফেদ প্রচ্ছদ।
সবুজ মাঠের শেষে দিগন্ত পেরুনো
ছবি আর গ্রাম দোল-খাওয়া দুবেণী
চোখের আনন্দ
তোমোকে দেবো বলে সেই কবে থেকে
অপেক্ষা করছি তুমি আসবে কখন!
যেন আমি নদী বয়ে যাচ্ছি বয়ে যাচ্ছি
কূল ভেঙে ভেঙে বয়ে যাচ্ছি
গভীর আকুতিমাখা চোখ বন্ধ করে
সরল বালিকা, শুধু তোমারই জন্য।
কোনো কিছুতেই এখন আর কোনো কিছুই নেই
অদৃশ্য শয্যায় গভীর ঘুমেতে আচ্ছন্ন নিঃসঙ্গ দোয়েল
বকুল বিকেল শিউলি সকাল ভোরের পুকুর
কোনোকিছুতেই এখন আর কোনো কিছুই নেই
আগ্রহ নেই
মুগ্ধতা নেই
আনন্দ সাম্পান নেই
কারো কাছে কোনো প্রশ্ন নেই
ক্ষোভ নেই
তৃষ্ণার আগুন নেই
পাগলা বৈশাখে বুক ভাঙাভাঙি নেই
প্রবল জলপ্রপাতে ভেসে যাওয়াও নেই
এমন কী বেণী দোলানো সবুজ দিগন্তও নেই
হৃদয়ের মঞ্চে প্রতিনিয়ত নাটক মঞ্চস্থ
চোখের অভিনবত্বে হরণের গল্প
মধুকণ্ঠে কী সুন্দর বিষের পেয়ালা
নিঃসঙ্গ দোয়েল আপন দুঃখে
নিজেকে নিজেই আন্টার্কটিকা করে ঘুমিয়ে দিয়েছে।
অদৃশ্য এক নগরের গল্প
আমাদের অনেক কিছুই অনাদরে খসে গেছে
বৃক্ষের বাকল খসে যাওয়ার মতো,
আমাদের অনেক কিছুই অবহেলায় ভেসে গেছে
নদীর নিঠুর বুকে স্বপ্ন নিরুদ্দেশ হওয়ার মতো।
আমরা এখন অন্যের আপন থাকি
আমরা এখন অন্যের করে নিজেকে রাখি,
আমরা আসলে আমাদের নেই
আমরা কোথাও একটুও আমরা নেই।
তবুও আমরা বেঁচে থাকি
তবুও আমরা ভালোবাসি,
আমাদের ঘর নেই—একখণ্ড জমিন নেই
নিজস্ব ঠিকানা নেই—কোথাও কোনো পরিচয় নেই।
তবুও এই দেশেই থেকে যাবো হাওর-বাঁওড়ের গানে
রাখালিয়া সুরে—অজস্র বুনোফুলের প্রাণ মাতানো ঘ্রাণে।
বিশ্বাস ভেঙে গেলে কিছুই থাকে না
বিশ্বাস ভেঙে গেলে কিছুই থাকে না
তবুও বিশ্বাসের মতো করেই
বাঁচতে হয়, বাঁচেও।
মন্দির ভেঙে গেলেও পূজার আকুতি থাকে
ভাঙাহৃদয়েও থাকে
ভক্তির সমর্পণ।
বিশ্বাস ভেঙে গেলেও
ভালোবাসা থাকে মনের দেউলে
বেদনা লুকিয়ে হাসিমুখে
ভালোবাসা নদী হয়ে যায়—ঢেউ হয়ে যায়।
শ্যামের বাঁশরী
কেউই থাকে না—শুধুই শ্যামের বাঁশরী কেঁদে কেঁদে থেকে যায়
নদীও তো একদিন যৌবনের গান নিভে চলে যায়,
নিজের বুকেই নিজেকে হারায় স্বপ্নের মৌতায় খরায় পুড়িয়ে
ঢেউয়ের উন্মত্ত মাতাল পিপাসারা তখন কঙ্কাল হয়।
চোখের মায়ারা মরিচীকা ভুলের রোদ্দুর হয়ে যায়
বুকের কম্পন নতুন জমিনে উর্বরতার উৎসব হয়,
নতুন জীবনে সবুজের কবিতার পঙক্তি হয়
অকস্মাৎ বর্ষায় মরা নদীও যৌবন পায়—ভেসে যায় পুরনোজীবন।
সবই তো চলে যায়—সবই হারায়—কিছুই যায় না—হারায় না কিছুই
নতুন রূপেতে ফেরে শুধু পলিমাটিতে নতুন জীবনের সুর,
এইসব বুকে নিয়েই তো ভালোবেসে যায় নিরুদ্দেশ সন্ধ্যাদোয়েল
বুকের কম্পনে বদলায় জীবনের গল্প— মেলেনা তো হিসেবের চারকোণ।
বেণি দুলানো পথেরা—ঝিঁঝিঁ পোকার মায়াবী মুঠো মুঠো আলো
কোথায় হারিয়ে গেলো—চেনা পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ
কতো রামধনু কতবার যে প্রেমের রঙে জন্মালো-মরলো!
কোথায় কিভাবে ভেসে গেলো পবিত্র মমতাভরা বাড়ির উঠোন।
তুমিও তো একদিন চলে যাবে—মল্লিাকাদির মতো
অথবা রহস্যময় বনলতা কিংবা লাবণ্য হিসেবি রূপাগ্নি জয়নাব
বুকের গহীনে অদৃশ্য অজস্র বিষধর নীলবিষ দংশন,
কেউই থাকে না—চলে যায়—শুধুই শ্যামের বাঁশরী কেঁদে কেঁদে থেকে যায়।
সাদাসিধে ময়লা শাড়িতে
বারান্দায় বসে মুখ নিচু করে বসে আছি
উঠোনে মায়ের পা’র দাগ
মা হাঁটছেন—দেখছি বিমুগ্ধ নয়নে
সাধারণ তাতের একটা শাড়ি
আঁচল ঝুলছে—কবিতা ঝুলছে
মা জড়িয়ে আছে নিশ্বাসের পাণ্ডুলিপি।
দোচালা টিনের ঘর—রক্তজবা খোঁপা হয়ে আছে
রমণীদেউড়ি—এখানেই জেগে থাকে দুচোখ মায়ের—
কখন ফিরবে ভালোবাসা—ঘরের পাখিরা!
উঠোনের কোণে ঘাসফুল—আমার জানালা ঘেঁষে
সুঘ্রাণে ছড়িয়ে আছে বেলফুল
কোত্থেকে কখন একজোড়া চড়ুই সজনে ডালে
ঠোঁটে ঠোঁট মেখে মেতে থাকে কবিতার উষ্ণতায়।
বারান্দায় মুখ নিচু করে বসে থাকি
পিতামহের প্রশস্ত বুক—সম্রাটের মতো বাবা
বুকভরে দোল-খাওয়া আত্মজা
কচুরিফুলে ভোরের রোদের গা ঘেঁষে আপন রমণী
কবুতরের বাচ্চার মতো দোয়েল পাখির মতো
কাদামাটি বুক ভরে থাকা ভাইবোন
জড়িয়ে রয়েছে কলমিলতার মতোন
সেইসব দিন খুঁজি বাড়ির উঠোনে উৎসবের আলো।
কষ্টে বুক পুড়ে গেলে মুখ নিচু করে
বসে থাকি শৈশবের বারান্দায়—
নীরবে গভীরভাবে মুখটা জড়িয়ে রাখি
মায়ের শরীরে— খুবই সাদাসিধে ময়লা শাড়িতে।
মাটিও মাটি থেকে পর হয়ে যাচ্ছে
আজকাল সবকিছুতেই এতবেশি মিথ্যা
এতবেশি চতুরতা অভিনয়
সবুজ গাছের ছায়াতেও ভয়
নদীর স্রোতেও তবে কি নাটক
মাটিতে মাটিতেও কি দূরত্ব?
আজকাল সবকিছুতেই লুকানো লুকানো খেলা!
আকাশও ছল জানে
ছায়াও ছল জানে
রোদ্দুরও ছল জানে
ঢেউও ছল জানে
সবাই তো ভেবে নেয় বোঝে না কেউ কিছু।
আজকাল সবাই সবকিছু বুঝেও না বুঝে
হেসে হেসে ভেসে যায়
মেঘে মেঘে মিশে যায়
কোনো কথা না বলে নীরবে ভালোবেসে যায়।