বাঙালির দুর্গাপূজা শুধু একটা ধর্মীয় উৎসব নয়—এটা যেন এক আবেগ, এক মিলনমেলা। চার দিন ধরে মা দুর্গাকে ঘিরে চলে আনন্দ, ভক্তি, আর পরিবার-পরিজনের একসঙ্গে থাকার উষ্ণতা।
আর এই আনন্দের শেষ দিন, বিজয়া দশমী, হয়ে ওঠে এক মিষ্টি-কষ্টের দিন। কারণ সেদিন মা দুর্গা কৈলাসে ফিরে যান তার স্বামী শিবের কাছে। আর এই বিদায়ের আগে হয় এক বিশেষ রীতি—সিঁদুর খেলা।
সিঁদুর খেলা কীভাবে হয়?
দশমীর সকালে, বিসর্জনের আগে, বিবাহিত নারীরা দেবী দুর্গার চরণে সিঁদুর নিবেদন করেন। এরপর তারা একে অন্যকে সিঁথিতে, কপালে এবং গালে সিঁদুর দেন। হেসেখেলে সবাই একসঙ্গে মেতে ওঠেন লাল রঙের উৎসবে।
কিন্তু কেন হয় এই সিঁদুর খেলা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে পাওয়া যায় ইতিহাস, পৌরাণিক কাহিনি, আর সমাজচেতনার এক মিশ্র রূপ। সহজ করে বলা যায়: দেবী দুর্গার কন্যারূপ ও সংসারের কামনা এই সময় দেবী দুর্গাকে কন্যারূপে দেখা হয়—যিনি বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি, মানে কৈলাসে ফিরছেন। তাকে সিঁদুর পরিয়ে যেন বলা হয়, ‘তোমার দাম্পত্য জীবন হোক সুখী ও মঙ্গলময়।’
এই ভাবনারই ছোঁয়া পড়ে নারীদের মধ্যে। বিবাহিত নারীরা একে অপরকে সিঁদুর দিয়ে প্রার্থনা করেন—ঘর-সংসার যেন অটুট থাকে, ভালোবাসা চিরকাল টিকে থাকে।
হিন্দু ধর্মে সিঁদুরের প্রতীকী মানে
সিঁদুর হিন্দু সংস্কৃতিতে শুধু প্রসাধন নয়—এটা সৌভাগ্য, শক্তি, প্রেম আর সংসার জীবনের প্রতীক। পৌরাণিক মতে, সিঁদুর ব্রহ্মার প্রতীক—যিনি জীবনে আনন্দ, সৃষ্টিশীলতা আর মঙ্গল নিয়ে আসেন। কপালে সিঁদুর দিলে নাকি ব্রহ্মার অধিষ্ঠান ঘটে, এই বিশ্বাস থেকেই এই রীতির শুরু।
বিজয়া দশমী মানেই বিদায়ের কষ্ট। মা চলে যাচ্ছেন, এটা মানতে কষ্ট হয়। সেই কষ্টকে একটু হালকা করতে, নারীরা একে অন্যকে রাঙিয়ে তোলেন লাল সিঁদুরে। যেন বলেন, ‘তোমার জীবন হোক রঙিন, মায়ের মতো শক্তিশালী।’
সিঁদুর খেলা আজ শুধু রীতি নয়, এক সামাজিক মিলনও। এই খেলার সবচেয়ে সুন্দর দিক হলো—নারীদের মধ্যে বন্ধন, মিলন আর আনন্দের প্রকাশ। বয়স, সামাজিক অবস্থান ভুলে সবাই একসঙ্গে রাঙিয়ে ওঠেন লালে লালে।
আধুনিক সময়ে, যদিও এই রীতি মূলত বিবাহিত নারীদের, অনেক জায়গায় অবিবাহিত মেয়ে, এমনকি পুরুষরাও যোগ দেন আনন্দে। ফলে এটা হয়ে উঠেছে একটা সামাজিক উৎসব—ধর্মীয় গণ্ডি ছাড়িয়ে একেবারে প্রাণের।
সিঁদুর খেলা হলো বিদায়ের মাঝে আশার রং। এটা এক রঙিন বার্তা—‘বিদায় আছে, কিন্তু বন্ধন অটুট থাকবে। দেবী দুর্গা চলে গেলেও, তার আশীর্বাদ রয়ে যাবে সংসারে, জীবনে, সমাজে।’
এফপি/অআ