ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত গাইড বই শিক্ষার্থীদের দিয়ে জোরপূর্বক কিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে।
এসব বই বিক্রির পেছনে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের শিক্ষক। যারা স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের প্রকাশনা সংস্থার কাছ থেকে টাকা বা কমিশন পেয়ে থাকেন। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে এমন বাণিজ্যিকীকরণ শিশুদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছে। শিক্ষকদের দায়িত্ব যেখানে আলোকবর্তিকা হয়ে শিক্ষার্থীদের পথ দেখানো, সেখানে যদি তারা টাকার লোভে তাদের বই বিক্রির মাধ্যম বানিয়ে ফেলেন, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।
ফলস্বরূপ একদিকে অর্থনৈতিক চাপে পড়ছেন দরিদ্র অভিভাবকরা, অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা মূল পাঠ্যবই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে শর্টকাট মুখস্থ নির্ভর পড়াশোনার দিকে। জরুরি ভিত্তিতে বিষয়টি নজরে এনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি অভিবাবকদের।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব গাইড বই মূল পাঠ্যবই থেকে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ সরিয়ে দিচ্ছে। তারা শর্টকাট বা মুখস্থ নির্ভর হয়ে পড়ছে। এর ফলে তাদের বিশ্লেষণী ও সৃজনশীল চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে।
গাইড বই মুখস্থ নির্ভরতা বাড়ায়, পাঠ্যবই ও সৃজনশীল চিন্তা থেকে শিক্ষার্থীরা দূরে সরে যায়। এতে ভবিষ্যতে এক প্রজন্ম মেধাহীন ও নকল-নির্ভর হয়ে উঠবে। একটি শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ এবং শিশুবান্ধব পরিবেশ। অথচ সেই জায়গা থেকেই যখন বাণিজ্য ও স্বার্থপরতা জন্ম নেয়, তখন তা শুধু একটি জেলার সমস্যা থাকে না। এটি হয়ে ওঠে গোটা জাতির জন্য অশনিসংকেত।
বাঞ্ছারামপুরের ১৩৯টি বিদ্যালয়ের এই চিত্র যেন সারাদেশে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়- শিক্ষার নামে কী ভয়াবহ অবক্ষয় চলছে। প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বইয়ের দাম ১৮০ থেকে ৬৭০ টাকা পর্যন্ত, যা গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।
প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ১৩৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এ সকল বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থী রয়েছে ৪৭ হাজার ৯৩২জন। এরমধ্যে প্রাক-প্রাথমিকে ৪ হাজার ৪০২ জন, প্রথম শ্রেণীতে শিক্ষার্থী রয়েছে ৯ হাজার ৩৪০ জন, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ৯ হাজার ১৪০ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৮ হাজার ৮১০ জন, চতুর্থ শ্রেণীতে ৮ হাজার ২১০ জন, পঞ্চম শ্রেণীতে ৮ হাজার ৩০ জন।
এই সকল বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকরা বিভিন্ন প্রকাশনীর কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে পপি প্রকাশনী, লেকচার প্রকাশনী, ফুলকুড়ি প্রকাশনী, এভারেষ্ট প্রকাশনী, জুপিটার প্রকাশনী, নিউটন প্রকাশনী, সংসদ প্রকাশনীর গাইড বই নিজ নিজ বিদ্যালয়ে পাঠ্য করছেন। গাইড বইয়ের কারণে শিক্ষকরা পাঠ্যবই না পড়িয়ে গাইড বইয়ের সূচি অনুযায়ী পড়াচ্ছে। এতে করে কমলমতি শিক্ষার্থীরা পাঠ্য বইয়ের পাঠদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
রূপসদী দক্ষিণ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আতিকা সুলতানা জানান, আমাদের স্কুলের স্যার বলেছেন আমাদের গাইড কিনতে, তাই আমি এই গাইড কিনেছি ৭০০ টাকা দিয়ে। গাইড পড়লে নাকি পড়াশোনা সহজ হবে। স্যাররা গাইড বই থেকে আমাদের পড়ান।
কমলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক ইয়ামিন মিয়া জানান, স্কুল থেকে গাইড বই কেনার কথা বলা হলে আমার মেয়ে গাইড কিনতে আমাকে বললে আমি বাঞ্ছারামপুর থেকে ৬৫০ টাকা দিয়ে ফুলকুড়ি একটি গাইড এনে মেয়েকে দিয়েছি। সবাই গাইড কিনছে এ কারণে মেয়েও কিনে দিতে জোর করেছে, তাই কিনে দিয়েছি। আসলে গাইড বই কখনও প্রকৃত শিক্ষা দেয় না। পাঠ্য বই মূল শিক্ষার চাবিকাঠি, শিক্ষকরা নিজেদের সুবিধার জন্য এইসব গাইড বই শিক্ষার্থীদের দিয়ে পড়াচ্ছে।
রূপসদী উত্তর বাজারের প্রভাতী লাইব্রেরীর মালিক দুলাল আহমেদ জানান, গাইড বই চাহিদা থাকার কারণে আমরা গাইড বই এনে বিক্রি করি, যে গাইড বই চায় ওইটা আমরা দেই। আমি ফুলকুড়ি প্রকাশনীর এজেন্ট। আমি কোন স্কুলে গাইড পাঠ্য করার বিষয়ে কথা বলি না। প্রকাশনীর লোকজন আছে তারা স্কুলে যায়। তবে কিছু বিদ্যালয় আছে যারা আমাদের সাথে সম্পর্কের কারণে ভালোটা নিতে বললে আমরা সেটা দেই।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক শিক্ষক জানান, বিভিন্ন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে তাদের ইচ্ছামত গাইড বই পাঠ্য করছেন, এতে করে মূল বই এর পড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। তাদের মেধা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে তারা শর্টকাট পড়া লেখা করার কারণে ভবিষ্যতেও তাদের নানা সমস্যায় পরতে হবে।
ফরদাবাদ মুন্সিবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাবুল জালালী জানান, আমরা কাউকে বলিনা কোন গাইড পড়তে, তবে আমাদের এখানে লেকচার ও ফুলকলি গাইড পড়ে শিক্ষাথীরা। আমাদের কোন চাহিদা নেই। যা টাকা দিয়েছে তা দিয়ে আমরা শিক্ষকরা মিলে খেয়ে ফেলেছি।
রূপসদী উত্তর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এর প্রধান শিক্ষক মমতাজ বেগম জানান, আমাদের বিদ্যালয়ে ৭৭০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। গাইড বই থেকে পড়াতে শিক্ষাথীদের সহজ। কারণ এখানে সমাধান দেওয়া থাকে। বিশেষ করে ইংরেজীটা খুবই উপকার হয়, কারণ ইংরেজিটা বাংলায় লিখা থাকে। আমি কোন নগদ টাকা নেই না। স্কুলের বিভিন্ন প্রয়োজনে ও অনুষ্ঠানের সময় লাইব্রেরীর মালিক দুলালের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে থাকি।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আবদুল আজিজ জানান, গাইড বই স্কুলে পড়ানোর বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। কেউ যদি এই ধরনের কাজে জড়িত থাকে, প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোন শিক্ষার্থীকে গাইড বই কিনতে বাধ্য করা যাবে না, গাইড বই কোনভাবেই স্কুলে আনা যাবে না। মূল বই থেকে শিক্ষাথীদের পড়াতে হবে, অন্য কোথাও থেকে পড়ানো যাবে না।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও শিক্ষা কমিটির সভাপতি ফেরদৌস আরা জানান, গাইড বই নিষিদ্ধ কোনোভাবেই গাইড বই কেনার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দিতে পারবে না শিক্ষকরা। এমন যদি হয় বিষয়টা আমি দেখব। পাঠ্যবই থেকে পড়াতে হবে গাইড বই থেকে পড়ানোর কোন সুযোগ নেই। আর গাইড বই স্কুলে আনা কোনভাবেই সম্ভব নয়। আর কোন শিক্ষক যদি গাইড বই কেনার বিষয়ে নির্দেশনা বা প্ররোচিত করে থাকে, সত্যতা পেলে তা বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এফপি/রাজ