ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার বাসিন্দা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা মনোজ চৌধুরী স্থানীয় বাজার থেকে গত শনিবার টেংরা, পাবদা, মেনি (ভেদা) মাছ কিনেছেন। পরদিন দুপুরে মোবাইল ফোনে কথা হলে মনোজ চৌধুরী বলেন, ‘মাছের আসল স্বাদ তো বাংলার মাছে। প্রতিনিয়তই বাজার থেকে কিনে আনি। দামও খুব একটা বেশি না।’
বাংলাদেশের মাছ নিয়ে অন্য রকম আবেগ আগরতলার হকার্স মার্কেটের কসমেটিকস ব্যবসায়ী উত্তম পালের। জানালেন, বাংলাদেশে তাঁর দাদুর (মায়ের বাবা) বাড়ি। তাই বাজার থেকে নিয়মিত দাদুর দেশের মাছ কিনেন। শুধু ত্রিপুরা রাজ্য নয়, ভারতের সেভেন সিস্টার্স (উত্তর-পূর্বের সাত রাজ্য) হিসেবে খ্যাত সব কটি অঞ্চলেই বাংলাদেশের মাছের ব্যাপক চাহিদা।
ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল রাজ্যের মানুষের কাছে অন্যতম চাহিদার পণ্য এই মাছ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ওই সব রাজ্যে প্রতিনিয়তই মাছ রপ্তানি করা হয়। মূলত ত্রিপুরায় রপ্তানি করা হলেও সেখান থেকে বাকি ছয় রাজ্যে পৌঁছে যায় বাংলাদেশের মাছ। এখানকার মাছ যাওয়া না যাওয়ার ওপর নির্ভর করে সেখানকার মাছের দামও।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে গড়ে প্রতিদিন কোটি টাকার বেশি মাছ রপ্তানি করা হয়। সর্বশেষ গত সোমবার গেছে এক কোটি ৫০ লাখ টাকার মাছ। প্রতি কেজি মাছ যায় আড়াই ডলার করে। এসব মাছের মধ্যে রয়েছে রুই, কাতল, মৃগেল, পাঙ্গাশ, টেংরা, পাবদা, মেনি ইত্যাদি। এর মধ্যে পাঙ্গাশ মাছ যায় সবচেয়ে বেশি, যা ওই সাত অঞ্চলের পাহাড়ি মানুষের কাছে খুব প্রিয়।
স্থানীয়ভাবে সংগ্রহের পাশাপাশি একাধিক জেলা থেকে আসা মাছ হিমায়িত করে ভারতে রপ্তানি করা হয়।
ভারতের সেভেন সিস্টার্স মূলত স্থল ও পাহাড় বেষ্টিত। রাজ্যগুলো ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। সমুদ্র কিংবা বড় কোনো নদী না থাকায় স্থানীয় মাছও খুব একটা নেই। স্বাদে ভালো, সহজলভ্য এবং তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় সেখানে বাংলাদেশি মাছের বিরাট বাজার তৈরি হয়েছে, যা দুই পক্ষের বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে চিন্ময় দাস গ্রেপ্তার ইস্যুসহ বিভিন্ন কারণে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি দেখা দেয়। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ভারতের ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত বিক্ষোভ হয়। ত্রিপুরায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনারের আগরতলার কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। তার মধ্যেও সেখানে বাংলাদেশের মাছের চাহিদা ছিল ব্যাপক।
এ বছরের ডিসেম্বরেও ওপারে বাংলাদেশি মাছের চাহিদা অব্যাহত আছে। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার ৭০ টনেরও বেশি মাছ আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি করা হয়েছে। শুক্রবার ও রবিবার বাদে সপ্তাহে পাঁচ দিন এই বন্দর দিয়ে মাছ রপ্তানি করা হয়।
আখাউড়া স্থলবন্দর মাছ রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ফারুক বলেন, ‘দিন দিন ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বাংলাদেশের মাছের চাহিদা বেড়ে চলছে। ওপারের বাজার বাংলাদেশের মাছের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল।’
আখাউড়া স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নেসার উদ্দিন ভূঁইয়া গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, ত্রিপুরাসহ ভারতের সাতটি রাজ্যে বাংলাদেশি মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারছে। সেকেন্ড স্যাটারডে উপলক্ষে ১৩ ডিসেম্বর শনিবার এবং সাপ্তাহিক বন্ধ হিসেবে পরের দিন রবিবার মাছ রপ্তানি হবে না। তাই শুক্রবার বন্ধ থাকার দিনেও মাছ পাঠানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আজ (গতকাল) ৭০.১৫ টন অর্থাৎ এক লাখ ৭৫ হাজার ৩৭৫ ডলার মূল্যের মাছ ভারতে রপ্তানি করা হয়েছে। তবে রপ্তানি কাগজ নিয়ে জটিলতায় মাছ যেতে দেরি হয়। এখন অনলাইন পদ্ধতি করা হলেও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। এ ছাড়া মাছ রাখার শেড না থাকায় রপ্তানিতে দেরি হলে সমস্যা হয়।’
আখাউড়া উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মাছও এ বন্দর দিয়ে ভারতে যায়। হিমায়িত এসব মাছ খাওয়ার উপযোগী কি না সেটা পরীক্ষা করে ‘ফিশ হেলথ সার্টিফিকেট’ দেওয়া হয়।
এফপি/অ