সরকার দেশের পেঁয়াজ বাজার স্থিতিশীল করতে ভারত থেকে আমদানির সিদ্ধান্ত নিলেও বাস্তবে বাজারে তার সামান্য প্রতিফলনও নেই। বরং পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে—পেঁয়াজ আমদানি যেন ব্যবসায়ীদের একটি অংশকে আরও বেশি সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জানাচ্ছে—সরবরাহ বাড়ছে, দাম কমবে। কিন্তু খুচরা বাজারে দাঁড়ালে সেই বক্তব্যটিই মানুষকে ব্যঙ্গের মতো শোনাচ্ছে। কারণ, দোকানের তাকের ওপর যে দাম লেখা আছে, তা আগের চেয়ে কম নয়—বরং কিছু এলাকায় আরও বেশি।
চট্টগ্রামের আমদানিকারক রফিকুল ইসলাম রফি ভারত থেকে পেঁয়াজ ঢোকানোর অনুমতি পাওয়ার পর কয়েকটি চালান দেশে এনেছেন। তার মতে, সরকার আমদানি খুলে বাজারে স্বস্তি আনতে চাইলেও ব্যবসার একটি বড় চক্র সেই উদ্যোগকে ইচ্ছাকৃতভাবে অকার্যকর করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, “আমরা বাজারে কম দামে সরবরাহ দিতে চাই, কিন্তু দাম কমার যে স্বাভাবিক প্রভাবটা পড়ার কথা ছিল—তা কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এর মানে খুব পরিষ্কার—বাজারের কোথাও সিন্ডিকেট সক্রিয় আছে এবং তারা চাইলে এই দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।” তার বক্তব্যে স্পষ্ট হতাশার ছাপ—যেন তিনি নিজেও বাজারে এই অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।
খাতুনগঞ্জের পাইকার মো. সালাহউদ্দিন অবশ্য ধীরে ধীরে দাম কমার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নিজেই যেন সেই সিন্ডিকেট-গন্ধকে পরোক্ষে স্বীকার করে ফেলেন। তিনি বলেন, “বাজারে নতুন দাম ঠিক হতে সময় লাগে। সবাইকে আগের মজুদের দাম সামলে নিতে হয়।” তার মন্তব্যে স্পষ্ট বোঝা যায়—পাইকারি ব্যবসায়ীরা পুরোনো মজুতের অজুহাত দেখিয়ে দামের পতন ঠেকিয়ে রাখছেন। এতে খুচরা বাজার চাপের মুখে পড়ে এবং স্বাভাবিকভাবেই দাম কমে না। ফলে ভোক্তারা সরকারি সিদ্ধান্তের কোনো সুফল পান না।
খুচরা বিক্রেতাদের অবস্থাও করুণ। তারা ভোক্তার তীব্র ক্ষোভের প্রথম লক্ষ্যবস্তু হলেও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই। বাদামতলীর দোকানি শফিকুল আলম শফিক বলছিলেন, “ক্রেতারা আসে আর তেড়ে থাকে—দাম কমাইছেন না কেন? কিন্তু আমরা কি আকাশ থেকে পেঁয়াজ নামাই? পাইকারে যত দামে কিনি তার ওপর সামান্য লাভেই বিক্রি করি। পাইকারি বাজারে আসলেই দাম কমলে আপনাদের সামনে হাসিমুখ নিয়ে কম দামে দিতে পারতাম।” তার কথায় অসহায়ত্বই বেশি—যেন খুচরা বিক্রেতারা সত্যিই দুই দিক থেকে চাপে পড়েছেন।
তবে বাজারে সবচেয়ে তীব্র ক্ষোভ সাধারণ ভোক্তাদের। ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির ঘোষণায় কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও বাজারে এসে তারা দেখছেন—দাম কমার কোনো চিহ্নই নেই। চান্দগাঁও এলাকার গৃহিণী সাবিনা আক্তার ক্ষোভ গোপন করেননি। তিনি বলেন, “এটা কি জনগণকে বোকা বানানোর আরেকটা উপায়? টিভিতে বলছে দাম কমবে, আমদানি হয়েছে। কিন্তু বাজারে এসে দেখি সব আগের মতোই। তাহলে কার জন্য এই আমদানি?” তার প্রশ্নটি এখন হাজারো ভোক্তার কণ্ঠস্বর।
এনায়েতবাজারে দেখা যায় আরও তীব্র প্রতিক্রিয়া। সেখানে কেনাকাটা করতে আসা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, “এই দেশে বাজার বলে কিছু নেই, আছে শুধু বাজারের ওপর ব্যবসায়ীদের রাজনীতি। সরকার আমদানি করুক বা দাম কমানোর ঘোষণা দিক—সিন্ডিকেট যদি না চায়, দাম কমবে না। আর ভোক্তাদের কণ্ঠ কেউই শোনে না।” তার কণ্ঠে ক্ষোভের সঙ্গে হতাশাও ছিল—যেন একজন নাগরিক তার মৌলিক ভোগ্যপণ্যের জন্যও নিরাপত্তা পাচ্ছে না।
চৌমুহনী এলাকার চাকরিজীবী শারমিন নাহার বলেন, “সারা বছর পেঁয়াজের অজুহাত বদলায়—কখন আবহাওয়া, কখন সংকট, কখন ট্রাক ধর্মঘট। কিন্তু আশ্চর্যভাবে দাম কখনোই কমে না। কারণ এর পেছনে যারা আছে তারা সবাই ক্ষমতাশালী। তারা চাইলেই বাজার নাচিয়ে নিতে পারে।” তার বক্তব্যে যে হতাশা, তা শুধু ব্যক্তিগত নয়—এটি গোটা দেশের ভোক্তা সমাজের সুর।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, আমদানির সুফল যদি খুচরা বাজারে না পৌঁছায়, তবে তা স্পষ্টই সিন্ডিকেটের শক্তির ইঙ্গিত। তাদের মতে, আমদানি বাড়লেও যখন বাজারে কৃত্রিম স্বল্পতা দেখানো হয়, তখন খুচরা দাম ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়ে যায়। আর এ ভাবেই মধ্যস্বত্বভোগীরা সরকারি সিদ্ধান্তের পুরো লাভ নিজেদের পকেটে ভরে নেয়, অথচ ভোক্তা কেবল পকেট খালি করতে থাকে।
এদিকে বাজারে অনিয়ম দমনে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বুধবার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে অভিযান চালায়। নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করায় সততা বাণিজ্যালয়কে ৫০ হাজার ও গ্রামীণ বাণিজ্যালয়কে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। উপপরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ বলেন, “আমদানির পরও কেউ যদি বেশি লাভের আশায় ভোক্তাকে ঠকায়, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তবে এ অভিযানে ভোক্তারা সাময়িক স্বস্তি পেলেও তাদের মনে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—একদিনের অভিযান দিয়ে কি বাজার সিন্ডিকেটের অদৃশ্য শক্তিকে দমন করা সম্ভব?
অবশেষে মূল প্রশ্নটি আরও জোরালো হয়ে ফিরে আসে—সরকার আমদানি করছে, বাজারে সরবরাহ বাড়ছে, প্রশাসন অভিযান চালাচ্ছে; কিন্তু সাধারণ মানুষের ঘরে কি পেঁয়াজের দাম কমছে? ভোক্তারা বলছেন, বাজার ব্যবস্থা যদি সিন্ডিকেটের হাতে নিয়ন্ত্রিত থাকে, তবে যত আমদানি করা হোক, যত অভিযানই দেওয়া হোক—শেষ পর্যন্ত ঠকতে হবে শুধু তাদেরই।
এফপি/অ