রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পুরাতন কপার স্ক্রাপ কিনতে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন বটিয়াঘাটা উপজেলার আমিরপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. সেলিম শেখ। ৪০ লাখ টাকা খুইয়ে তিনি সর্বশান্তই হননি, মিথ্যা মামলায় জেল খাটতে হয়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে চক্রটির নিয়মিত মহড়া এবং হুমকিতে আতঙ্কে দিন পার করছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) খুলনার আদালতের বারান্দায় মাথায় হাত দিয়ে কাদতে থাকেন ওই যুবক। তার কাছে এগিয়ে গেলে সাংবাদিক শুনে ঘটনা প্রসঙ্গে মো. সেলিম শেখ বলেন, বটিয়াঘাট উপজেলার নারায়নখালী এলাকার বাসিন্দা মো. ইকবাল হোসেন পূর্ব পরিচিত হওয়ায় প্রতারক প্রদীপ সরকার ওরফে নরেশ বাবু ওরফে সোহেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ওই প্রদীপ নিজেকে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্পের পাওয়ার ম্যাক্স কোম্পানীর ব্যবস্থাপক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয়।
পরিচিত হওয়ার এক পর্যায়ে সেলিমের কাছে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্পের পাওয়ার স্টেশনের ৪৫ টন কপার স্ক্রাপ প্রতিকেজি ৪৫০ টাকা দরে বিক্রির প্রস্তাব দেয় প্রতারক প্রদীপ। যার বাজার মূল্য ২ কোটি ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রতারণার উদ্দেশ্যে ভুক্তভোগীকে ৪০ লাখ প্রদানের প্রস্তাব দেওয়া হলে তার ব্যবসায়িক অংশিদারদের সাথে আলোচনা করে তাকে জানানো হবে বলে জানানো হয়। বিষয়টি লাভজনক হওয়ায় সেলিম অন্যান্যদের সাথে আলোচনা করে কপার স্ক্রাপ কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। টাকা দেওয়ার জন্য ব্যাংক হিসেব নম্বর চাইলে সেলিমকে বলা হয় যেহেতু আপনারা ব্যবসায়িক পার্টনার চারজন তাই আলাদা আলাদা না দিয়ে একসাথে টাকা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে ওই প্রতারক ।
সেলিম আরো জানান, গত বছরের (২৫ ফেব্রুয়ারী) ৪০ লাখ টাকা দেওয়া হয় প্রতারক প্রদীপকে। প্রদীপ নিজ স্বাক্ষরিত একটি ভুয়া মানি রিসিট এবং ভুয়া ওয়ার্ক অর্ডার প্রদান করে সেলিমকে। টাকা দেওয়ার পরেরদিন ট্র্রাক ভাড়া করে সেলিম পাওয়ার ম্যাক্স কোম্পানীতে কপারস্ক্রাপ নিতে গেলে ওই কোম্পানী থেকে তার ট্রাকটিকে বের করে দেয়। এ ঘটনার পরে প্রদীপ সরকার একটি গাড়িতে এসে ভুক্তভোগীকে বলে আজ তাকে মাল দেওয়া হবেনা। আগামী একসপ্তাহের মধ্যে মাল বুঝে পাবেন বলে সেলিমকে শান্তানা দেয় ওই প্রতারক।
সেলিম বলেন, বিষয়টি তার কাছে সন্দেহজনক হওয়ায় খোজ খবর নিতে শুরু করেন। পরে জানতে পারেন পাওয়ার ম্যক্স কোম্পানী ব্যবস্থাপক প্রদীপ সরকার ওরফে নরেশ বাবু একই ব্যক্তি নন। তখন তিনি ৪০ লাখ টাকা ফেরত চাইতে গেলে পরবর্তীতে টাকা পরিশোধ করা হবে বলে ওই প্রতারক জানান। পরবর্তীতে প্রদীপ নামে ওই ব্যক্তি ১৫-২০ জনকে সাথে নিয়ে সেলিমের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে এক ব্যক্তিকে ভুয়া ইট বালি এবং সিমেন্টের ব্যবসায়ী সাজিয়ে উল্টে তার কাছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা পাবে বলে দাবি করে। তিনি বাড়িতে না থাকায় পরিবারের সদস্যদের শাসিয়ে আসে প্রদীপ।
একই বছরের (৭ সেপ্টেম্বর) রাত ৯ টার দিকে সেলিম বটিয়াঘাটা থানাধীন জয়পুর বাজারে অবস্থান করার সময় পাওয়ার ম্যাক্স কোম্পানীর পরিচয় দেওয়া ভুয়া ব্যাবস্থাপক একটি প্রাইভেট কার এবং পিকআপে ১৫-২০ জনকে সাথে নিয়ে সেলিমকে অপহরণের উদ্দেশ্যে আসে। বাধা প্রদান করলে তাকে বেদম মারপিট করা হয়। এ ঘটনায় তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ভাংচুরও করে তারা। এ সময় তার সাথে থাকা বেয়াই মো. শওকত হোসেনের মোটরসাইকেলটি উঠায় নিয়ে যায়। ওই সময় সেলিম বটিয়াঘাটা থানায় একটি জিডি করেন। যার নম্বর ৪১৩, তারিখ: ০৭-০৯-২৪ইং।
ওই প্রতারক চক্রের অব্যাহত হুমকির কারণে সেলিম নিজ বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়িতে অবস্থান করে। পরে গত বছর (১০ অক্টোবর) সেলিম বাদী হয়ে নালীশী মামলার আমলী আদালতে একটি প্রতারণা ও মারধোর মামলা দায়ের করেন। খুলনা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আল আমিন মামলাটি তদন্তের জন্য সোনাডাঙ্গা থানার ওসিকে দায়িত্ব দেন। মামলাটি তদন্ত করেন ওই থানার এসআই শান্তুনুর রহমান এবং রিপোর্ট আদালতে তার পক্ষে প্রদান করেন। পরে পিবিআইও তদন্ত করে তার পক্ষে রিপোর্ট দেয়।
সেলিম আরও বলেন, ৪০ লাখ টাকা নেওয়ার পর মালামাল না দিয়ে উল্টো প্রতারক প্রদীপের সহযোগী তারিকফুলকে দিয়ে ঢাকার শ্যামপুর থানায় তার বিরুদ্ধে একটি প্রতারণা মামলা (নং-১১/৪৪) দায়ের করে। এই মামলায় সিআইডি এসআই মো. আরিফ হোসেন এ বছরের ৫ অক্টোবর ডুমুরিয়া থেকে তাকে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। পরে সেলিম জামিন নিয়ে খুলনায় ফিরে আসে।
সেলিম বর্তমানে ডুমুরিয়া নতুন রাস্তার মোড়ে পুরাতন কাপড়ের ব্যবসা করছেন। প্রতারক চক্রটি থেমে থাকেনি। তারা তার প্রতিষ্ঠানে গিয়ে অব্যাহত হুমকি দিচ্ছে। প্রাণে বাচার তাগিদে পালিয়ে জীবন যাপন করছে সেলিম।
এদিকে জানতে চাইলে ঢাকার শ্যামপুর থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডি'র এসআই মো. আরিফ হোসেন বলেন, প্রতারণার মামলায় তাকে এ বছরের ৫ অক্টোবর খুলনার ডুমুরিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি জামিনে বের হয়ে যান। আমরা ঘটনাগুলো শুনেছি। তাকে সব ডকুমেন্টগুলো নিয়ে ঢাকায় আসার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
সেলিমের পক্ষের আইনজীবী বলেন, সেলিমের দায়ের করা মামলার আসামি প্রদীপ ওরফে নারেশ বাবু ওরফে সোহেল, মো. ইকবাল হোসেন, তারিক ওরফে তারেক, জয়নাল ফকির, বশির ওরফে বশির ডাকাত এবং বোরহানউদ্দিন প্রতারক প্রকৃতির। তাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে কয়েকটি থানায় প্রতারণার অভিযোগে মামলা রয়েছে। এ মামলার দু'জন আসামি জামিনে রয়েছে। অন্য আসামিরা পলাতক রয়েছে। এদের মধ্যে প্রদীপ ও তারিফুল বেপরায়া প্রকৃতির। যে কোন সময় তারা সেলিমের প্রাণ নাশের হুমকির কারণ হতে পারে।
এফপি/জেএস