এক সময় রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মৃগী ও বোয়ালিয়া ইউনিয়নে সকাল শুরু হতো তাঁতের শব্দে। টুক টুক করে বাজতো কাঠের সাঁড়াশির মতো তাঁত মেশিন। শত শত পরিবার জীবিকা নির্বাহ করত এই শিল্পকে ঘিরে। তাঁত ছিল শুধু জীবিকা নয়, ছিল সংস্কৃতি, ছিল পরিচয়। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে বদলে গেছে জীবনের গতি। আজ এই ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প দাঁড়িয়েছে বিলুপ্তির মুখে। ব্যয়বহুল হাতে তৈরি তাঁতের শাড়ি আজ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। তাঁতিরা পাচ্ছেন না ন্যায্য মূল্য, নেই সঠিক বিপণন ব্যবস্থা।
যন্ত্রের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে হাতের শিল্প। যেখানে একসময় শতশত তাঁত কাজ করত, এখন হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র। বর্তমান সময়ে লুঙ্গি- গামছা তৈরির সুতা এবং কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিসহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বন্ধ হতে চলেছে ঐতিহ্যবাহী হস্তচালিত তাঁতশিল্প। এর ফলে তাঁতিরা এখন তাদের পেশা ছেড়ে দিয়ে প্রবাসে চলে যাচ্ছেন, নয়তো অন্য কোন পেশায় সম্পৃক্ত হয়েছেন। আর নতুন প্রজন্ম মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে– কারণ এই পেশায় ভবিষ্যৎ নেই, নিশ্চয়তা নেই।
কালুখালী উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের চরচিলোকা গ্রামের তাঁত শ্রমিক রফিকুল বিশ্বাস বলেন, আমার জন্মের পর থেকেই এই কাজ দেখে আসছি। এই কাজ আমার দাদা করতো, আমার বাবা করতো এখন আমিও করি। এই পেশাটা ৩০/৩৫ বছর আগে খুব ভালো চলতো, এখন আর সেরকম চলে না। আগে চারটা গামছা বানালে ১৫০ টাকা ইনকাম হতো, এখন ১০০ টাকা হয়। এখন এই কাজ প্রায় সবাই বাদ দিয়ে দিচ্ছে। এই গ্রামে আগে প্রায় ২০০ লোক এই কাজ করতো, কিন্তু এখন ৮/১০ জন এই কাজ করে। এখন কেউ কৃষি কাজ করে, কেউ ভ্যান চালায়, কেউ আবার বিদেশ চলে গেছে। এখন অনেকেই বৈদ্যুতিক মেশিন দিয়ে এই কাজ করে, কিন্তু আমাদের তো সামর্থ্য নেই তাই মেশিন কিনতে পারিনা। একটা মেশিনের দাম দুই লক্ষ টাকা।
নুরুজ্জামান মিয়া নামক আরেক তাঁত শ্রমিক বলেন, বাপ দাদার আমল থেকে এই কাজ করে আসতেছি। এটা আমাদের জাতি ব্যবসা, তবে এই কাজ করে আমরা ভালো নেই। একজন দিন মজুরও দিনে ৫০০/৭০০ টাকা ইনকাম করে আর আমরা ইনকাম করি ৩০০ টাকা। তারপর সুতা ও রংয়ের দাম অনেক বেশি। সরকার যদি এদিকে একটু নজর দিত তাহলে আমরা স্ত্রী সন্তান নিয়ে চলতে পারতাম।
এ বিষয়ে কালুখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহুয়া আফরোজ বলেন, তাঁত শিল্প বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অংশ। এটি এদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে জড়িত। একটা সময় দেশের অনেক মানুষ এই শিল্প নিয়ে কাজ করতো। কালুখালীতেও একটা বড় জনগোষ্ঠী তাঁত শিল্প নিয়ে কাজ করতো। তবে এখন সেই সংখ্যা খুবই সীমিত। আমরা ইতিমধ্যে তাদের সাথে যোগাযোগ করেছি। কালুখালী উপজেলার মৃগী ও বোয়ালিয়া ইউনিয়নে কিছু লোক এখনও এই পেশার সাথে জড়িত। তাদের সাথে আমরা কথা বলেছি, তাদের কে স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দিতে কাজ করছি। এখন সবাই বৈদ্যুতিক মেশিন দিয়ে কাজ করছে। যাদের বৈদ্যুতিক মেশিন নেই, তারা হাত দিয়ে চালিত মেশিন দিয়ে কাজ করছে। তাদের কেও বৈদ্যুতিক মেশিন দেওয়ার একটা পরিকল্পনা করছি। ঐতিহ্য এই পেশাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কালুখালী উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যা কিছু করা সম্ভব আমরা সেগুলোই করার চেষ্টা করছি।
এফপি/এমআই