রাত পোহালেই পহেলা বৈশাখ। বৈশাখ মাসকে কেন্দ্র করে ব্যস্ততা বেড়েছে বাঁশির কারিগরদের। তাদের দম ফেলার সময় নেই। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে পাইকাররা ভীড় করেছেন বাঁশির গ্রামে।
কুমিল্লার হোমনা উপজেলার ছোট্ট গ্রাম শ্রীমদ্দি। শ্রীমদ্দি গ্রামটিকে মানুষের কাছে সুপরিচিত কেবল বাঁশির গ্রাম হিসেবে। গ্রামটিতে বসবাস করেন প্রায় ৪০টি বাঁশির কারিগরদের পরিবার। শ্রীমদ্দী গ্রামে বাঁশি তৈরির ঐতিহ্য শত বছরের। বংশপরম্পরায় ধরে রেখেছে পূর্বপুরুষদের সৃষ্টিশীল কাজটি। তৈরি করা এসব বাঁশি সরবরাহ করা হবে সারা দেশে। সারা বছর কিছুটা চাহিদা থাকলেও বৈশাখে এর চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। দিন কয়েক পরে বাঙালিদের প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ। এ উপলক্ষে দেশব্যাপী বসে মেলা। সেই মেলার প্রাণ হলো বাঁশের বাঁশি। এখন বাঁশি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন নারী-পুরুষ সব বয়সের কারিগরেরা।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের মোট তৈরিকৃত বাঁশির ৭০ ভাগ বাঁশি তৈরি হয় শ্রীমদ্দি গ্রামে। গ্রামটির বাঁশি তৈরির ঐতিহ্য একশ থেকে সোয়া শ বছরের। পরম্পরা ধরে রেখে পূর্বপুরুষদের সৃষ্টিশীল কাজটি এখনো চালিয়ে যাচ্ছে কিছু মানুষ। শুধু টিকে থাকাই নয়, কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শ্রীমদ্দি গ্রামের কারুশিল্পীদের নিপুণ হাতে তৈরি বাঁশি যাচ্ছে দেশের বাইরেও। বাঁশি কারিগরা জানান, কয়েকমাস পরই বৈশাখী মেলা। মেলায় তারা আশা করছেন তাদের তৈরি প্রায় ৩ থেকে ৫ কোটি টাকার বাঁশি সারাদেশে বিক্রি হবে। যদি না কোন দুর্বিপাক না হয়। সে বিক্রির আশায় তারা নতুন স্বপ্ন বুনছেন। আশা করছেন, সারাবছর যে ধারদেনা আর বিভিন্ন এনজিও/মহাজন থেকে মোটা সুদে ঋণ এনে বাঁশির কাঁচামাল কিনে বাঁশি বানিয়ে দেশ-দেশান্তরে পাঠিয়েছেন বিভিন্ন ব্যবয়াসী ও পাইকারদের মাধ্যমে লাভের মধ্যদিয়ে পুঁজিসহ লাভ উঠে আসবে।
সরেজমিনে শ্রীমদ্দির অনিল দাসের বাড়িতে দেখা গেলো, বাড়ির নারী পুরুষ ও ঘড়ে বৌ-ঝি সবাই মিলে বাঁশিতে রং করছেন। মিলেমিশে বাঁশি তৈরির ছোটবড় সবাই। কেউ ছোট ছোট করে মুলি (বাঁশ) কাটছেন। কেউ সিক দিয়ে ছিদ্র করছেন, কেউ আগুনের ছেঁকা দিয়ে বাঁশির গায়ে নকশা করছেন। কেউবা নকশা ফুটিয়ে তুলছেন রংতুলিতে। বাঁশিতে রং করছিলেন গৃহবধূ মৌসুমী,৯ম শ্রেণির ছাত্রী। তিনি জানালেন, বাঁশি তৈরি ও বিক্রি করেই সংসার চলে। তবে শুধু জীবিকার জন্যই নয়, মনের টান থেকেও এই কাজ করেন তারা। পুরনো কারিগর জয়নাল জানালেন, শ্রীমর্দ্দীর অন্তত ৪০টি পরিবার বাঁশিশিল্পে যুক্ত। পরিবারের সব বয়সের নারী, পুরুষ, শিশু সবাই কোনো না কোনো ধাপে বাঁশি তৈরিতে হাত লাগান। সুনীল বিশ্বাসে স্ত্রী ঝর্ণা বিশ্বাস জানান, একটি বাঁশি তৈরিতে ১৩ থেকে ১৪টি ধাপ থাকে। এটি মূলত মুলি বাঁশ দিয়ে তৈরি হয়। ১৩ থেকে ২০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয় বাঁশিগুলো।
বাঁশির কারিগরদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ফটিক ছড়ি ও ভারতীয় সীমান্ত এলাকা থেকে তাঁরা সরু মুলি বাঁশ কিনে আনেন। প্রথমে এ বাঁশ রোদে শুকানো হয়। এরপর বিভিন্ন ধরনের বাঁশির উপযোগী বাঁশগুলো বাছাই করে বেছে মসৃণ করে মাপ অনুসারে কাটতে হয়। মোহন বাঁশি, নাগিনী বাঁশি, মুখ বাঁশি, আড় বাঁশিসহ নানা ধরনের বাঁশি তৈরি করেন কারিগরেরা। এসব বাঁশির দাম ডিজাইন ও গুণাগুণ ভেদে ৫ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
বাঁশির কারিগর যতীন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস বেশ গর্বের সঙ্গেই বলেন, শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশি দেশের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরে মধ্য প্রাচ্যের দেশসমূহ, ইউরোপ, জাপান, সিঙ্গাপুর, ইতালি, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প রপ্তানিতে সহায়তা করে।
এফপি/এমআই