সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ঘিরে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নিয়ে ভিন্ন অবস্থানে রয়েছে এক সময়ের রাজনৈতিক মিত্র বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। কমিশনের প্রস্তাবে সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘জাতীয়তাবাদ’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ বাদ দেওয়ার কথা বলা হলেও, বিএনপি তাতে দ্বিমত পোষণ করেছে। অপরদিকে, জামায়াত এ পরিবর্তনে একমত পোষণ করে আলাদাভাবে কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন মনে করেনি।
জামায়াত এক ধাপ এগিয়ে প্রস্তাব করেছে, সংবিধানের মূলনীতিতে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’, ‘ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ’, ‘সাম্য’, ‘মানবিক মর্যাদা’, ‘সামাজিক সুবিচার’ এবং ‘গণতন্ত্র’ যুক্ত করার। তবে তারা ‘বহুত্ববাদ’ শব্দটি বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। কমিশনের খসড়ায় ‘বাংলাদেশ একটি বহুজাতি, বহুধর্মী, বহু সংস্কৃতির দেশ’ বলা হলেও, জামায়াতের প্রস্তাব—জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের মর্যাদা নিশ্চিতের ওপর জোর দেওয়া হোক।
অন্যদিকে, বিএনপি চায় সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদ পঞ্চদশ সংশোধনের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হোক। এসব অনুচ্ছেদে ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘সমাজতন্ত্র’, ‘গণতন্ত্র’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিএনপি সংবিধানকে তাদের ক্ষমতার সময়কার অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চায়। তাদের অবস্থান ১৯৭৬ সালের সেই অধ্যাদেশঘোষিত রূপের অনুরূপ, যেটি জিয়াউর রহমান প্রবর্তন করেছিলেন। তার মতে, এটাই জামায়াতেরও পছন্দের কাঠামো, কারণ এতে ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গা ক্ষীণ।
এদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সংবিধান থেকে পুরনো মূলনীতি বাদ দিয়ে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র’ যুক্ত করার পক্ষে। তবে রাষ্ট্রের নাম বদলে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ এর পরিবর্তে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
কমিশনের মোট ৭০টি প্রস্তাবের মধ্যে জামায়াত ৩১টিতে একমত, ২৩টিতে দ্বিমত এবং ১৬টিতে আংশিক একমত জানিয়েছে। বিশেষ করে প্রস্তাবিত ‘নাগরিকতন্ত্র’ ধারণা, সংসদের উচ্চকক্ষের আকার ও ক্ষমতা, নারী সংরক্ষিত আসনের কাঠামো, এবং জরুরি অবস্থা জারির প্রক্রিয়া নিয়ে দলটির নানা পর্যবেক্ষণ রয়েছে।
জরুরি অবস্থার বিষয়ে জামায়াত চায়, রাষ্ট্রপতি যেন শুধুমাত্র জাতীয় সাংবিধানিক কমিশনের (এনসিসি) সুপারিশক্রমে তা জারি করতে পারেন। অন্যদিকে, বিএনপি মনে করে, এটি নির্বাহী শাখার এখতিয়ার এবং সংসদের বাইরে এ ক্ষমতা দেওয়া উচিত নয়।
সবশেষে, জামায়াত আবারও সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে, যা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দলটির মতে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
একই জোটে থাকা সত্ত্বেও, সংবিধান সংস্কারে বিএনপি ও জামায়াতের এ ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান তাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক দূরত্বেরও ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এফপি/রাজ