শীতের হাওয়ায় মোড়া ডিসেম্বরের সকাল। শ্রীমঙ্গল শহরের আকাশে সূর্যের আলো জেগে উঠতেই উপজেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সামনে শুরু হয় রঙিন মানুষের জমায়েত। ব্যানার হাতে, রঙিন পোশাকে, হাসি-আনন্দে মুখরিত উৎসবমুখর পরিবেশ-সব মিলিয়ে যেন শহরে আগে থেকেই নেমে আসে হারমোনি ফেস্টিভ্যাল সিজন-২-এর আগাম রঙ।
আজ সকাল ১১টায় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বের হওয়া বর্ণাঢ্য র্যালি শ্রীমঙ্গলের সংস্কৃতিমনা মানুষকে নিয়ে যায় এক ভিন্ন আবেগে, যেখানে আছে বৈচিত্র্যের গৌরব, সম্প্রীতির দৃঢ়তা এবং শিল্প-সংস্কৃতির উচ্ছ্বাস।
র্যালির শুরুতেই নজর কাড়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির তরুণ-তরুণীদের ঐতিহ্যবাহী পোষাকে অংশগ্রহন। তাদের রঙিন পরিধেয়, মাথার পালক, হাতের বাজনা-সবকিছু যেন বলে দিচ্ছিল, ‘বৈচিত্র্যই আমাদের শক্তি, আমাদের পরিচয়।’ বাঙালি, খাসিয়া, মান্দি, মনিপুরি, তৃণমূল বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির অংশগ্রহণ র্যালিকে শুধু বর্ণিলই করেনি, করেছে শ্রীমঙ্গলের বহুসংস্কৃতির বাস্তব চিত্র তুলে ধরারও একটি অসাধারণ সুযোগ।
র্যালিতেই উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকা, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিকবৃন্দ, বিএনসিসি, স্কাউট, গার্ল গাইডস, থানা পুলিশ, ট্যুরিষ্ট পুলিশসহ সর্বস্তরের মানুষ। অনেকেই পরিবারসহ এসেছেন-কারও হাতে শিশু, কারও ক্যামেরা, কারও চোখে উৎসাহ।
এক কলেজ শিক্ষার্থী বললেন-‘শ্রীমঙ্গলে এমন আয়োজন আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চাকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়। আমরা প্রত্যেকেই বৈচিত্র্যের অংশ।’
র্যালির উদ্বোধন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইসলাম উদ্দিন। উপস্থিত জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘হারমোনি ফেস্টিভ্যাল শান্তি, সম্প্রীতি ও বৈচিত্র্যের প্রতিনিধি। এই উৎসব আমাদের পরিচয়কে আরও সুন্দরভাবে তুলে ধরে। শ্রীমঙ্গলকে সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে এ আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, ‘শ্রীমঙ্গল শুধু চায়ের রাজধানী নয়-এটি জাতিগোষ্ঠির সংস্কৃতির মিলনভূমি। এই উৎসবের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে শ্রীমঙ্গলের সাংস্কৃতিক সারাংশ তুলে ধরা হবে।
র্যালিটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-স্টেশন রোড, কোর্ট রোড, গুহ রোড, হবিগঞ্জ রোড, মৌলভীবাজার রোড, চৌমুহনা প্রদক্ষিণ করে। র্যালি এগোতেই রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে মানুষ হাততালি আর উল্লাসে সাড়া দেন। মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে ব্যস্তপ্রায় সবাই।
অনেক প্রবীণ মানুষ বলেন-‘এমন রঙিন র্যালি বহু বছর পর দেখলাম। মনে হচ্ছে উৎসবটা সত্যিই সবার।’ শহরের দোকানিরাও দোকান থেকে বের হয়ে দেখেছেন রঙিন শোভাযাত্রা। কারও মুখে বিস্ময়, কারও চোখে আনন্দ।
আগামী ১৮-২০ ডিসেম্বর তিন দিনব্যাপী ফুলছড়া চা বাগান মাঠে অনুষ্ঠিত হবে হারমোনি ফেস্টিভ্যাল সিজন-২। আয়োজন থাকবে-ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, লোকজ ও আধুনিক সংগীত, হস্তশিল্প ও ঐতিহ্যবাহী প্রদর্শনী, নাচ, দেশি খাবারের স্টল, চা-সংস্কৃতি প্রদর্শনী, পর্যটন সম্পর্কিত তথ্যকেন্দ্র।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড জানিয়েছে, এবারের উৎসবে দেশজুড়ে পর্যটক ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সমাগম হবে বলে তারা প্রত্যাশা করছেন।
আজকের র্যালির সফল আয়োজনের পর শহরের সাধারণ মানুষের মধ্যেও দেখা গেছে তীব্র আগ্রহ। অনেকেই বলেছেন-‘এই র্যালি দেখে বোঝা যাচ্ছে, এবারের হারমোনি ফেস্টিভ্যাল আগের চেয়ে অনেক বড় হবে।’
শহরের চায়ের দোকান, বাজার, চা বাগানের শ্রমিক কলোনি-সবখানে এখন আলোচনায় উৎসবের রঙ, র্যালির উচ্ছ্বাস আর ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির সাজসজ্জা।
শ্রীমঙ্গলের রাস্তাজুড়ে ছড়িয়ে পড়া র্যালি যেন বার্তা দিয়েছে-বহু জাতি, বহু সংস্কৃতি, কিন্তু আমরা এক শ্রীমঙ্গল। হারমোনি ফেস্টিভ্যাল সেই ঐক্যেরই প্রতীক। র্যালি যেমন শহরে উৎসবের আগাম রঙ ছড়িয়ে দিল, তেমনি তিন দিনব্যাপী মূল আয়োজনও শ্রীমঙ্গলকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলবে-এমনটাই আশা স্থানীয়দের।
এফপি/অ