চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে কাস্টম আইন উপেক্ষা করে বেআইনিভাবে বিচারাদেশে হস্তক্ষেপ, রাজস্ব ফাঁকি ও আমদানিকারকদের হয়রানির ভয়াবহ অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন হাউসের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ মারুফুর রহমান ও কমিশনার মোহাম্মদ শফি উদ্দিন।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা বিচারাদেশে নয়ছয় করে আমদানিকারকদের অবৈধ সুবিধা দিয়েছেন এবং কিছু কর্মকর্তার মাধ্যমে ভয়ভীতি ও অতিরিক্ত জরিমানার মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করা হচ্ছে। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কাস্টম আইনে একই পণ্য চালানে একাধিকবার বিচারাদেশ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু রাজধানীর খান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি করলে যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ মারুফুর রহমান প্রথমে ১২ লাখ টাকা জরিমানা (১০ লাখ টাকা জরিমানা ও ২ লাখ টাকা বিমোচন জরিমানা) করে পণ্য খালাসের আদেশ দেন। পরে তিনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে সেই আদেশ গায়েব করে নতুন বিচারাদেশ জারি করেন। নতুন আদেশে জরিমানা অর্ধেকে নামিয়ে মাত্র ৬ লাখ টাকায় চালান ছাড়ার অনুমতি দেন। অথচ আইন অনুযায়ী একবার বিচারাদেশ হলে তা পরিবর্তনের সুযোগ নেই। অসন্তুষ্ট হলে আপিলের বিধান রয়েছে, কিন্তু এখানে আপিল ছাড়াই জরিমানা কমানো হয়েছে—যা কাস্টম আইন সরাসরি লঙ্ঘন।
অন্যদিকে কমিশনার মোহাম্মদ শফি উদ্দিন-এর বিরুদ্ধেও গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। গাজীপুরের বন্ডেড প্রতিষ্ঠান ইউনিক ডিজাইনার্স বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আনলে তিনি তাদের ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা জরিমানা করেন। আইন অনুযায়ী, শুল্ক ও জরিমানা মিলে প্রায় ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা আদায় করার কথা ছিল। কিন্তু গত ১৩ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটি মাত্র ৪ হাজার ২২৪ টাকায় পণ্যের চালান খালাস করে নেয়। কাস্টম হাউসের একাধিক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, কমিশনার নিজেই বিচারাদেশ দেওয়ার পরও জরিমানা আদায় না করেই পণ্য ছাড়ার অনুমতি দিয়েছেন। এতে কাস্টম আইনের বিধান পুরোপুরি উপেক্ষিত হয়েছে।
কাস্টমসের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ মারুফুর রহমান কাস্টম হাউসের জেটি এলাকা থেকে শুরু করে নানা দপ্তরে প্রভাব বিস্তার করেন। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠার পর জেটি শাখা থেকে সরিয়ে দেওয়া হলেও প্রভাবশালী এনবিআরের এক সদস্যের সহযোগিতায় এখনো চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে বহাল আছেন। এমনকি যশোরে বদলির আদেশ হলেও তিন সপ্তাহ ধরে রিলিজ আদেশ কার্যকর করা হয়নি।
কাস্টম হাউসে হয়রানি ও ঘুষ বাণিজ্য দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের। এক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী বলেন— “চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে এখন সীমাহীন হয়রানি চলছে। আমদানী ও রপ্তানীকারকদের উপর অন্যায় চাপ বাড়ছে। জরিমানার ভয়ভীতি দেখিয়ে এক শ্রেণীর কাস্টমস কর্মকর্তা অবৈধভাবে টাকা আদায় করছে। আমার এক আমদানিকারক ক্লায়েন্টের চালানে ২০০ শতাংশ জরিমানা করা হয়েছে—যা ব্যবসায়ের প্রতি স্পষ্ট অবিচার। ঘুষ দিলে ১০০ শতাংশ জরিমানা করে, আর না দিলে ২০০ শতাংশ জরিমানা চাপানো হয়।”
আইন অনুযায়ী, জরিমানা আরোপিত হলে তা পরিশোধের আগে কোনো পণ্য খালাস দেওয়া যায় না। কিন্তু এই দুই ঘটনায় সেই বিধান পুরোপুরি ভঙ্গ করা হয়েছে। একজন কাস্টম কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন— “এভাবে বিচারাদেশে হস্তক্ষেপ ও জরিমানা কমানোর মাধ্যমে সরকারের কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি গেছে। এটি সরাসরি ক্ষমতার অপব্যবহার।”
অভিযোগের বিষয়ে যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ মারুফুর রহমান ও কমিশনার মোহাম্মদ শফি উদ্দিনের বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা সাড়া দেননি। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ এখন প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনায় রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, রাজস্ব খাতের স্বচ্ছতা ও সুষ্ঠুতা রক্ষায় দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত অত্যন্ত জরুরি ।
এফপি/অ