শিরোনাম: |
দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে মঙ্গলবার রাত ১২টার পর থেকে কার্যকর হচ্ছে নতুন মাশুল কাঠামো। এতে গড়ে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত মাশুল বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার একে 'হার সমন্বয়' বললেও ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি এক অর্থনৈতিক ধাক্কা—যার প্রভাব পড়বে আমদানি–রপ্তানির ব্যয় থেকে শুরু করে সাধারণ ভোক্তার পণ্যের দামে পর্যন্ত।
চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরদের হাতে যাওয়ার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। পতেঙ্গা টার্মিনাল পরিচালনা করবে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে ইন্টারন্যাশনাল, লালদিয়া টার্মিনাল যাচ্ছে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক এপিএম টার্মিনালসের অধীনে, নিউমুরিং টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড, আর বে টার্মিনালের একটি অংশ পরিচালনা করবে সিঙ্গাপুরের পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল।
এর আগে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইএফসি তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, বিদ্যমান ট্যারিফ কাঠামো বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট নয়। সেই সুপারিশের পরই মাশুল বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নয়, বিদেশি কোম্পানিগুলোর সুবিধা দিতেই মাশুল বাড়ানো হচ্ছে। এতে আমদানি ব্যয় বাড়বে, যা শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কাঁধেই পড়বে।”
সরকারি গেজেট অনুযায়ী, প্রতি ২০ ফুট কনটেইনারে গড়ে ৩৯ ডলার বা প্রায় ৪,৪০০ টাকা মাশুল বাড়ছে। এতে প্রতিটি কনটেইনারে অতিরিক্ত ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ৬০ ডলার পর্যন্ত। এই খরচ প্রথমে বহন করবে শিপিং কোম্পানিগুলো, পরে তা আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের ওপর গিয়ে পড়বে এবং শেষ পর্যন্ত ভোক্তারা পণ্যের দামে এর প্রভাব টের পাবেন।
বন্দরের নতুন মাশুল কাঠামো কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানিগুলোও তাদের চার্জ বাড়াতে শুরু করেছে। মায়ের্সক লাইন ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, ২০ ফুট কনটেইনারে টার্মিনাল হ্যান্ডলিং চার্জ ১২০ ডলার থেকে বেড়ে ১৬৫ ডলার হবে, আর ৪০ ফুট কনটেইনারে ২০৫ ডলার থেকে বেড়ে ৩১০ ডলার হবে। অন্যদিকে সিএমএ সিজিএম, সিএনসি ও এএনএল লাইনও অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে প্রতি কনটেইনারে অতিরিক্ত ৪৫ ডলার সারচার্জ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এই চারটি শিপিং লাইনই বন্দরের ৩৬ শতাংশ কনটেইনার পরিবহন করেছে।
আইএফসির হিসাব অনুযায়ী, নতুন মাশুল কার্যকর হলে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতি কনটেইনারে ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ১৮৬ ডলার, যা বর্তমানে ১২৬ ডলার। এতে চট্টগ্রাম বন্দর দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় ব্যয়বহুল বন্দরে পরিণত হবে। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার সাউথ এশিয়া গেটওয়ে টার্মিনাল সবচেয়ে ব্যয়বহুল বন্দর হিসেবে রয়েছে।
বাংলাদেশ কনটেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ফাইয়াজ খন্দকার বলেন, বন্দরের জট ও বিলম্বের কারণে খরচ আগেই বেশি ছিল। এখন অতিরিক্ত মাশুল সেই ভারসাম্য ভেঙে দেবে। এতে ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের চাপের মুখে পড়বেন, যা শেষ পর্যন্ত পণ্যের দামে প্রতিফলিত হবে।
রপ্তানিকারক মোহাম্মদ আবদুস সালাম, এশিয়ান–ডাফ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বলেন, মাশুল বৃদ্ধিতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। বিদেশি ক্রেতারা যদি এই বাড়তি খরচ মেনে নিতে না চান, তাহলে রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতা কমে যাবে এবং অর্ডারও হ্রাস পেতে পারে।
ভোগ্যপণ্য ও শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা মনে করছেন, এক লাফে ৪১ শতাংশ মাশুল বৃদ্ধি ব্যবসা–বাণিজ্যের জন্য বড় ধাক্কা। সীকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, “ধাপে ধাপে মাশুল সমন্বয় করা হলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সহজ হতো। কিন্তু একসঙ্গে এত বৃদ্ধি দিলে খরচ বেড়ে যাবে বহুগুণে।”
সরকারের ব্যাখ্যা হলো, ১৯৮৬ সালের পর থেকে বড় পরিসরে মাশুল বাড়ানো হয়নি, তাই সময়োপযোগী হালনাগাদ অপরিহার্য। তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বিদেশি অপারেটরদের লাভ নিশ্চিত করার জন্যই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যার ফলে দেশের বাণিজ্য কার্যক্রম আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন মাশুল কাঠামোতে সরকার হয়তো কিছু রাজস্ব পাবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়বে আমদানি–রপ্তানি খরচ, বাজারদর এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ে। তাদের মতে, এই সিদ্ধান্তে লাভবান হবেন বিদেশি টার্মিনাল অপারেটররা, আর লোকসান গুনতে হবে দেশের ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের।
এফপি/অআ