কুষ্টিয়া জেলার অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা হলো কুষ্টিয়ার মিরপুর বাজার। জেলার দীর্ঘতম মিরপুর পৌর পশুহাট, উপজেলা পরিষদ, মিরপুর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মিরপুর-দৌলতপুর সড়কের জন্য একমাত্র সংযোগ স্থলে রয়েছে জিকে ক্যানেলের উপরের একটি ব্রীজ। দৌলতপুর ও মিরপুর উপজেলার প্রায় হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন এই ব্রীজ পারাপার হয় । 
উপজেলা পরিষদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী কাজ এবং হাসপাতালে যেতে একমাত্র অবলম্বন এই ব্রীজটি। পূর্বে এই স্থানে ব্রীজ থাকলে সেটিকে সংস্কারের প্রয়োজনের তাগিদে নতুন করে ব্রীজ নির্মান করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। দীর্ঘদিন ধরে ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এ ব্রীজটি নির্মান চলছে । জনদূর্ভোগ সৃষ্টি করে বেইলি সেতুর পরিবর্তে মানুষ প্রতিনিয়ত সেখানে বাঁশের সাঁকোতে পারাপার হচ্ছে।
নানা জটিলতায় প্রকল্পের কাজ কচ্ছোপ গতিতে চলছে। ইতিমধ্যে আবার নির্মান প্রকল্পের কাজের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে কাজ সমাপ্ত হবে এমন আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তবে কাজের গতিতে অনির্দিষ্টকালের দূর্ভোগের কথা জানায় স্থানীয়রা। এছাড়া ইতিমধ্যে ব্রীজটি দৃশ্যত হলেও তা ব্যবহারে সুফল পাবে না বলে সাধারন মানুষ দাবী করেছেন। অস্বাভাবিক উচ্চতা, রাস্তা এবং ব্রীজের সামনে নতুন করে দালান গড়ে উঠায় স্থানীয়রা আশঙ্কা করছে ব্রীজটি শুধুমাত্র দেখার জন্যই তৈরি হচ্ছে।
কুষ্টিয়া সড়ক ও জনপথ বিভাগ সুত্রে জানা যায়, খুলনা সড়ক জোনের আওতাধীন মহাসড়কে বিদ্যমান সরু ও ঝুঁকিপূর্ণ পুরাতন কংক্রিট সেতু/বেইলী সেতুর স্থলে কংক্রিট সেতু নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে কুষ্টিয়া সড়ক বিভাগের অধীন কুষ্টিয়া (ত্রিমোহনী)-মেহেরপুর সড়কের ৮ মাইল হতে মিরপুর থানা সংযোগ জেড-৭৪৫১ সড়কের সরু ও ঝুঁকিপূর্ণ পুরাতন কংক্রিট মেতু/বেইলী সেতুর স্থলে আরসিসি/পিসিগার্ডার ব্রীজ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় (৫৭.০৯৮ মিঃ  ২.২০০ মিঃ ৩০.৪৮৮ মিঃ) আরসিসি এবং পিসিগার্ডার মিরপুর বাজার ব্রীজ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০২৩ সালের ০৮ নভেম্বর কাজ শুরু হয়, শেষ হওয়ার মেয়াদ ছিলো ২০২৫ সালের ০৭ মে। কাজের বরাদ্ধ ছিলো ১৮ কোটি ৬৭ লাখ ১৭ হাজার টাকা। কংক্রিট এন্ড স্টীল টেকনোলজিস লিঃ, রানা বিল্ডার্স (প্রাঃ) লিঃ কাজটি পায়। প্রকল্প মেয়াদ শেষ হওয়ায় এক বছর বৃদ্ধি করে আগামী ৩০ জুন ২০২৬ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একবার প্রকল্প মেয়াদ শেষ হলেও ৫০ শতাংশ কাজও শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। সেতু নির্মাণে ধীরগতি এবং কাজের মান নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছেন স্থানীয়রা। তাদের দাবী প্রতিদিন ২-৩জন শ্রমিক নিয়ে কাজ করে। তাও সকালে করলে বিকালে করে না, আবার বিকালে করলে সকালে করে না। এভাবে সেতু নির্মান করার কারণে বছরের পর বছর পার হয়ে যাচ্ছে আবার পারাপারে দূর্ভোগ সৃষ্টি হলেও বাশের সাঁকো দিয়ে দিয়েছে যাতে ভোগান্তি আরো বেশি।
ব্রীজটির ১৫ ফিট সামনের দোকানী গোলাম হোসেন জানান, “ব্রীজের কাজ করে কি করেনা ওরাই জানে। এক বছর ধরে দেখি একজন দুইজন করে মাঝে মাঝে কাজ করে। এখানে আমরা কি বলবো। আমার মনে হয় এখনো এক থেকে দেড় বছর লাগবে ব্রীজ বানাতে যা দেখছি। আবার ব্রীজ থেকে নামার রাস্তার সামনেই বাজারের এক নেতা  ৫তলা বিল্ডিং করছে। ইঞ্জিয়াররা আসছে বলছে ব্রীজ বেশি উঁচু হলেও সমস্যা হবে না, সব নাকি ঠিক ঠাক করে দিবে। আমরা তো আর নেতা না যে আমাদের কথা কেউ শুনবে।”
ভ্যান চালক আব্দুল আজিজ জানান, “একতে ব্রীজ হচ্ছে মেলা উচা, তার উপরে উঠার কোন রাস্তা থাকবে না। এতে তো সমস্যা হবে, ব্রীজে উঠা যাবে না। সমস্যা হলে আর কি করা, বুলবে কে? ব্রীজের উঠার রাস্তা এমন বাঁকা হলে আমরা ছোটখাটো গাড়ি নিয়ে উঠতে পারবো না। সোজা হলে ভালো হতো। ব্রীজের সামনেই ঘরবাড়ী তৈরি হচ্ছে, এগুলো না সরালে তো সমস্যা হবেই।”
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, “যারা ব্রীজ করছে তারাই ভালো জানে কি কারণে এমন ব্রীজ করছে। তাদের মাথায় বুদ্ধি থাকলে এমন ব্রীজ করে না।”
স্থানীয় বাসিন্দা হুমায়ূন কবীর হিমু  জানান, “দেড় বছর ধরে এ ব্রীজের কাজ চলছে। মানুষের দূর্ভোগ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যা সীমাহীন বললেও কম হবে। বিকল্পভাবে চলাচলের কোন রাস্তা নেই। যার কারণে ১০ টাকার ভাড়া ৬০ টাকা দিতে হচ্ছে। তাও কোন ভ্যান, রিক্সা, অটো যায় না। একমাত্র উপায় হলো বাশের চরাটের উপর দিয়ে হেঁটে। তাও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। ব্রীজটি যে উচ্চতা হচ্ছে, যা নিচ দিয়ে জাহাজ চলার মতো, এমন স্থানে এমন ব্রীজ করা মানে মানুষের ভোগান্তি আরো বৃদ্ধি করা।”
তিনি অভিযোগ করে বলেন, “ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাজের প্রতি অনিহার কারণে এমন দায়সারা কাজ করছে বছর বছর ধরে।”
ব্রীজ নির্মানকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাইট ম্যানেজার আলিফ হোসেন জানান, "এটি হচ্ছে ৫৭ মিটারের একটি ব্রীজ। এখানে এ্যাপাটমেন্ট থেকে ৩০০ ফিট ড্রাইভেশন রাস্তা নির্মান হবে। এখানে দোকানপাট এবং নতুন করে স্থাপনা তৈরি কারণে ব্রীজের সামনে রাস্তা করা সম্ভব না। রাস্তা হলেও রাস্তাটি ব্রীজের সাথে সোজা হবে না, ব্রীজ থেকে এপ্রোসটি বাঁকা হবে। যার কারণে ব্রীজটি সুন্দর হওয়ার কথা থাকলে হবে না। রেলের জায়গা সংক্রান্ত বিষয়ের কারণে, বৈদ্যুতিক লাইন, পুরাতন ব্রীজের পাইল উঠানোর কারণে কাজ বিলম্বিত হচ্ছে।
ব্রীজটি প্রযুক্তি সম্বলিত হবে না বলে তিনি জানান, “পুরাতন যে স্টিমেট ছিলো সে অনুযায়ী কাজ করলে ভালো হতো কিন্তু এখন নতুন স্টিমেটের কারণে ভালো হবে না। দেখতেও খারাপ লাগবে। ব্রীজের সামনে নতুন স্থাপনা তৈরি এবং দোকানপাট থাকায় ব্রীজের মুখ থাকবে একদিকে রাস্তা থাকবে অন্য দিকে।”
এদিকে ব্রীজের একদম সামনেই নতুন করে ৫তলা বিশিষ্ট ভবনের কাজ শুরু করেছে মিরপুর পৌর বাজারের ব্যবসায়ী নেতা বাবলু চৌধুরী। তবে পৌরসভার অনুমোদন না থাকায় কাজটি বন্ধ করে দিয়েছে পৌর প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
বাবলু চৌধুরী  জানান, “এখানে যে ব্রীজটি হচ্ছে, আসলে আমাদের চাওয়া-পাওয়ার মতো হচ্ছে না। ব্রীজের উচ্চতায় দূর্ভোগে পড়বে সাধারন মানুষ। এই ব্রীজটি সাধারণ মানুষের গলার কাটা হয়ে যাবে। এখান থেকে কোন সুফল আসবে না।”
তিনি আরো জানান, “হঠাৎ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এখানে এসে আমার নির্মান কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। আমার ব্যক্তিগত জায়গায় মার্কেট করছিলাম আমি। পৌর সভায় ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ফি দিয়ে আবেদন করে মৌখিক অনুমোদনে কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু কাজ বন্ধ করে দিয়েছে।”
তিনি অভিযোগ করেন, “যে ব্রীজটি ১৫ ফিট উত্তরে হওয়ার কথা ছিলো, সেটি বিভিন্ন মানুষের চাপাচাপির কারণে ১৫ ফিট পশ্চিমে তৈরি হচ্ছে। কোন প্রকার স্থানীয়দের সাথে সমন্বয় না করেই এমন কাজ করছে কর্তৃপক্ষ।”
মিরপুর পৌরসভা সুত্রে জানা যায়, মিরপুর পৌর এলাকার ৬২২ নং খতিয়ানের মিরপুর মৌজার ৫১৪ নং দাগের উপরে যে ভবন নির্মান হচ্ছে পৌর সভা থেকে ভবন নির্মানের অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছিলো। তবে সেটি অনুমোদন হয়নি। 
মিরপুর পৌর প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম জানান, “সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যক্রম চলমানাধীন মিরপুর ঈগল চত্ত্বরে যে বহুতল মার্কেট নির্মান হচ্ছে এটা খুব হাইলি টেকনিক্যাল বিষয়। পৌর বিল্ডিং নকশা অনুমোদনের আবেদনে ১৩টি স্থানে সংশোধনী চেয়েছে বিল্ডিং নকশা অনুমোদন কমিটি। এজন্য আমরা নকশা সংশোধনের জন্য তাকে লিখিত চিঠি দিয়েছি, সেই সাথে অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত কাজটি স্থগিত করতে বলেছি।”
মিরপুর বাজার সংলগ্ন নির্মানাধীন ব্রীজটি হবে দৃষ্টিনন্দন এবং জেলার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ব্রীজ বলে দাবী করে কুষ্টিয়া সড়ক ও জনপথ বিভাগের মুহাম্মদ মনজুরুল করীম জানান, “ইতিমধ্যেই ব্রীজ নির্মানের ৪৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে পিসি গাডার টাসকিং এর কাজ চলমান রয়েছে। আশা করি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ হবে। পূর্ববর্তী সেতু বরাবরই নির্মিত হচ্ছে। এখানে কারিগরি ভাবে অসুবিধা হবে মনে হচ্ছে না। সেতুর উচ্চতা টেকনিক্যাল স্ট্যান্ডার্ন্ড মেনেই হচ্ছে। আশা করি সেতুটি নির্মান হলে সাধারন মানুষ সুফল পাবে ।”
এফপি/অআ