সবুজের বিস্ময়ভূমি শ্রীমঙ্গল। প্রকৃতির টানে, নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আহ্বানে প্রতিদিনই এখানে ভিড় জমে পর্যটকদের। পাহাড়, চা বাগান, কোলাহলহীন পথ আর পাখির কূজন মিলে এ অঞ্চল যেন প্রকৃতির আঁকিবুঁকি ক্যানভাস। সেই ক্যানভাসেরই এক অনন্য রঙ বিলাশছড়া চা বাগান। যা নিয়ন্ত্রিত হয় বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে। তবে শুধু গবেষণা বা চা উৎপাদনই নয়, এ বাগানের বুক জুড়ে আছে এক অনিন্দ্যসুন্দর লেক-যেন সবুজ পাহাড়ের কোলে জ্বলজ্বলে এক আয়না।
বিলাশছড়া চা বাগান মূলত একটি পরীক্ষামূলক চা বাগান। এখানে চা গাছের উৎপাদন, পরিচর্যা, নতুন জাতের চা নিয়ে নানা গবেষণা হয়। এ বাগানে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন একটি লেক। টিলা জুড়ে সবুজ চা গাছ, আঁকাবাঁকা পথ ধরে হেঁটে গেলে হঠাৎই চোখে পড়ে লেকটি। যেন চমক দিয়ে ওঠে প্রকৃতির গোপন উপহার।
এই লেকের মূল ব্যবহার চা বাগানের সেচ কাজে। গ্রীষ্মের দাবদাহে যখন মাটিতে ফেটে যায় তৃষ্ণার রেখা, তখন এ লেকের জল হয় প্রাণের দিশারী। শুধু সেচ নয়, লেকের জলে আছে মৎস্য সম্পদও। ফলে কৃষি ও মৎস্য, দুয়েরই এক অপূর্ব সমন্বয় সৃষ্টি হয়েছে এখানে।
লেকের চারদিকে উঁচু-নিচু টিলা, টিলায় সারি সারি চা গাছ। টিলাগুলো যেন পাহারাদার হয়ে ঘিরে রেখেছে নীলাভ জলরাশি। পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালার ছায়া পড়ে লেকের বুকে। হালকা বাতাস বইলে জলে তৈরি হয় ঢেউ, তাতে ভেসে ওঠে আলো-আঁধারির খেলা। দূর থেকে তাকালে মনে হয় লেকের বুকজুড়ে রঙিন কারুকাজ আঁকা।
প্রকৃতির এই মায়াবী দৃশ্য সহজেই মন কেড়ে নেয়। ব্যস্ত শহরের মানুষ হঠাৎ যদি এ লেকের ধারে এসে দাঁড়ায়, তবে তার চোখে ভেসে উঠবে এক স্বর্গীয় শান্তি।
শীতকালে এ লেক হয়ে ওঠে পরিযায়ী পাখিদের মিলনমেলা। দূর দেশ থেকে আসা এসব অতিথি পাখি লেকের জলে ভেসে বেড়ায়, খাবারের খোঁজে ডুব দেয়। কখনো তারা দল বেঁধে উড়ে বেড়ায় আকাশে, আবার কখনো ভিড় করে লেকের পাড়ে। প্রকৃতি যেন তখন এক অপূর্ব সিম্ফনির আয়োজন করে। পাখির কলকাকলি, জলের ঢেউ আর বাতাসের শিস মিলে এক সুরের মূর্ছনা তোলে।
আমি গতকাল গিয়েছিলাম সেখানে। বিলাশছড়া অফিস থেকে পথ শুরু করতেই চোখে পড়ল টিলা জুড়ে চা গাছের সারি, আর আঁকাবাঁকা সরু পথ। বেশ কিছুক্ষণ যাবার পর পথের বাঁক পেরুতেই হঠাৎ খুলে গেল দৃশ্যপট-সবুজের বুক চিরে জ্বলজ্বল করছে সেই লেক। মুহূর্তেই মনে হলো, আমি যেন কোনো রূপকথার রাজ্যে এসে পড়েছি।
লেকের ধারে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালে বোঝা যায়, প্রকৃতি কেমন নিখুঁতভাবে সাজিয়েছে এ স্থানটিকে। সবুজ টিলা, নীল আকাশ, স্বচ্ছ জল আর দূরের চা গাছের সারি মিলিয়ে যেন এক অপার্থিব চিত্রকল্প।
যে কেউ এ লেকের ধারে গেলে প্রকৃতির সঙ্গে তার এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হবে। চারপাশের নীরবতা, মাঝে মাঝে পাখির ডাক আর বাতাসের স্নিগ্ধ পরশ-সব মিলিয়ে মন ভরে যায় প্রশান্তিতে।
আসলে বিলাশছড়ার এই লেক শুধু একটি জলাশয় নয়, এটি যেন কবিতার ভাষায় লেখা এক নৈসর্গিক পঙক্তি। গবেষণার বাগানে জন্ম নেওয়া এই সৌন্দর্য অনাবিল আনন্দের উৎস হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির এমন দৃশ্য কেবল চোখকে নয়, মনকেও প্রশান্ত করে।
শীতের সকালে কুয়াশার চাদরে ঢাকা লেক, দুপুরে রোদের ঝিলিক, বিকেলে পাখির কলকাকলি আর সন্ধ্যায় নীরবতায় ডুবে থাকা লেক-প্রতিটি মুহূর্তই আলাদা সৌন্দর্যের বার্তা দেয়।
শ্রীমঙ্গলের বিলাশছড়া চা বাগান যেন গবেষণা ও সৌন্দর্যের এক অনন্য সংমিশ্রণ। এখানে রয়েছে বিজ্ঞানের অনুসন্ধান, আবার একই সঙ্গে রয়েছে প্রকৃতির কবিতাও। আর সেই কবিতার সবচেয়ে উজ্জ্বল পঙক্তি হচ্ছে এই লেক।
শান্তির খোঁজে থাকা যে কারও কাছে এ লেক হয়ে উঠতে পারে প্রশান্তির আশ্রয়। তাই বলা যায়, বিলাশছড়া চা বাগানের এই লেক শুধু একটি সেচ প্রকল্প নয়-এটি প্রকৃতির হৃদয়ে আঁকা এক অনিন্দ্যসুন্দর ছবি।
তবে এখানে প্রবেশাধিকার সীমিত। এই লেক দেখতে হলে অবশ্যই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে।
এফপি/রাজ