গত ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট শপথ গ্রহণ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সরকারের দায়িত্ব নেয়ার প্রায় ৬ মাস পর তিনি জানালেন, প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগে ও পরে ঠিক কী ঘটেছিল।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের দাভোস সফর করেন প্রধান উপদেষ্টা। ওই সময় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান ভাষ্যকার গিডিয়ন রাখমানের উপস্থাপনায় একটি পডকাস্টে কথা বলেন তিনি।
‘রাখমান রিভিউ’ নামের ওই পডকাস্ট অনুষ্ঠানে কথোপকথন গত বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) লিখিত আকারে প্রকাশ করা হয়। সেখানেই সরকার গঠনের প্রক্রিয়া ও ছাত্রদের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন ড. ইউনূস।
ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি যখন প্রথম ফোনকল পাই, তখন আমি প্যারিসের হাসপাতালে ছিলাম। আমার ছোট্ট একটি অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। তখন তারা (ছাত্রনেতারা) ফোন দিল। যদিও আমি বাংলাদেশে কী ঘটছে, সেসব খবর প্রতিদিন মুঠোফোনে দেখতাম। তখন তারা বলল, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) চলে গেছেন। এখন আমাদের সরকার গঠন করতে হবে। দয়া করে, আমাদের জন্য সরকার গঠন করুন।’
আমি বলেছিলাম, ‘না, আমি সেই ব্যক্তি নই। আমি এর কিছুই জানি না। আমি এর সঙ্গে যুক্ত হতেও চাই না।’ কারা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা। আমি তাদের কাউকেই চিনতাম না। কখনও তাদের সম্পর্কে শুনিনি। কাজেই আমি তাদের বিকল্প কাউকে খোঁজার বিষয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম। তাদের বলেছিলাম, বাংলাদেশে অনেক ভালো নেতা আছেন। তোমরা তাদের খুঁজে নাও।’
প্রধান উপদেষ্টার কথায়, ‘তারা বলছিল, না, না, না, আপনাকেই থাকতে হবে। আমরা কাউকে পাইনি।’ আমি বলেছিলাম, জোরালো চেষ্টা করো। তারা বলল, আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় নেই। তখন বলেছিলাম, অন্তত একটা দিন চেষ্টা করো। না পেলে ২৪ ঘণ্টা পর আমাকে আবার ফোন করো।’
এরপর শিক্ষার্থীরা আবারও ফোন করে বলে জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘তারা (ছাত্রনেতারা) আমাকে আবারও ফোন করল। বলল, আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু সম্ভব হয়নি। আপনাকে অবশ্যই দেশে ফিরতে হবে। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, দেখো, তোমরা রাজপথে জীবন দিয়েছো। প্রচুর রক্তক্ষয় হয়েছে। তোমরা সম্মুখসারিতে আছো। যেহেতু তোমরা এসব করতে পেরেছ, এখন ইচ্ছা না থাকলেও তোমাদের জন্য আমারও কিছু করা উচিত। আর এটাই সেই সময়। সরকারের সংস্কার করতে হবে। আমি রাজি। তোমরা কি একমত? তারা আর কোনো কথা বলেনি।’
সেই দিনের আরও কিছু অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘ঘণ্টা দুয়েক পর হাসপাতালের একজন নার্স এলেন। তিনি আমাকে একটি ফুলের তোড়া উপহার দিলেন। আমি বললাম, এটা কেন? তখন ওই নার্স বললেন, আপনি বাংলাদেশের ‘প্রধানমন্ত্রী’, আমরা এটা জানতাম না। আমি বললাম, এটা আপনি কোথা থেকে জানলেন। তখন তিনি বললেন, সব গণমাধ্যমে, সব টেলিভিশনে সংবাদ প্রচার হচ্ছে, আপনি বাংলাদেশের ‘প্রধানমন্ত্রী’। আমি বললাম, আমি আপনার কাছ থেকেই এটা জানলাম।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘এরও ঘণ্টা দুয়েক পর ওই বোর্ড সদস্যরাদসহ হাসপাতালের প্রধান আসেন। তারা ফুলের তোড়া দিয়ে নতুন ‘প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে আমাকে শুভেচ্ছা জানান। সঙ্গে এটাও বলেন যে বিকেলের আগে আমাকে হাসপাতাল ছাড়ার বিষয়ে অনুমতি দেয়া হবে না।’
এরপর প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি পরিচালককে বলি, ওরা আমাকে চাইছে। দেশে যেতে বলছে। ভ্রমণের জন্য আপনি কি আমাকে প্রস্তুত করে দিতে পারেন।’ তিনি বললেন, ‘অবশ্যই, আপনার কথা আমাদের মানতে হবে। আপনি একজন প্রধানমন্ত্রী। আপনার নিরাপদ যাত্রার জন্য আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে দেব। প্রয়োজনীয় ওষুধসহ সবকিছু দেব। সার্বক্ষণিক যোগাযোগে থাকব।’
প্রধান উপদেষ্টা জানান, এর কয়েক ঘণ্টা পর সকালে দেশে ফেরার জন্য ফরাসি সেনাবাহিনীর বড় একটি দল তাকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয়। তিনি বলেন, ‘এটাই ছিল দেশে ফেরার আগের ঘটনাবলি। পুরো জাতি আমার ফেরার বিমানের অপেক্ষায় ছিল। বাণিজ্যিক বিমানে যাত্রা করেছিলাম। তখন তারা (ছাত্রনেতারা) নতুন সরকারের রূপরেখা দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। আমি বিমানবন্দর থেকেই জাতির সামনে ভাষণ দিলাম। সবাইকে ধৈর্য, শান্তি, একতা বজায় রাখতে বললাম। এটাই ছিল পুরো ঘটনার শুরু।’
শিক্ষার্থীদের সম্ভাব্য নতুন রাজনৈতিক দল গঠন নিয়েও কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘তরুণরা সত্যিই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাদের খারাপ কোনো কিছুর সঙ্গে সংস্পর্শ নেই বা নিজেদের রাজনৈতিক আখের গোছানোর ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাও নেই। পরিস্থিতির প্রয়োজনে তারা রাজনৈতিক দল গঠন করছে বা রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছে। এটা দরকার। তারা দেশজুড়ে লোকজনকে সংগঠিত করছে।’
‘কারণ রক্ত দিয়ে তারা যেগুলো অর্জন করেছে, সেগুলো তাদের রক্ষা করতে হবে। অন্যথায় সেগুলো সেসব ব্যক্তি নিয়ে যাবে, যারা বিগত প্রশাসন ও অন্যদের মতো সবকিছুর পুনরাবৃত্তির সুযোগ খুঁজছে। এটাই বাংলাদেশে আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশ। সুতরাং তারা এটা রক্ষার চেষ্টা করছে। তাই আমি বলব, ছাত্রদের স্বচ্ছ অভিপ্রায় থাকবে,’ যোগ করেন।
এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘শুরুতে যখন আমি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করছিলাম, আমার উপদেষ্টা পরিষদে তখন তিন ছাত্রকে নিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, যদি তারা দেশের জন্য জীবন দিতে পারে, তারা উপদেষ্টা পরিষদে বসতেও পারে এবং যেটির জন্য জীবন দেওয়া হলো, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্তও নিতে পারে। তারা এখন ভালো কাজ করছে।’
তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা এখন বলছে, কেন আমরা আমাদের নিজেদের দল গঠন করছি না। আমরা একটি সুযোগ নেব।’ তবে ছাত্রদের দল গঠনের বিষয়টিকে অনেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। ছাত্ররা দল গঠন করলে একটি আসনও পাবে না এমন কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তিনি তাদের উৎসাহ দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস।
শিক্ষার্থীদের নতুন দল গঠনের চ্যালেঞ্জ বিষয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘দল গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে হয়তো তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এটাও একটা বিপদ। কারণ রাজনীতি শুরু করলে সব ধরনের রাজনীতিবিদ তাদের সঙ্গে মিশে যাবে। তাই আমরা জানি না– তারা আমাদের দেশের যে রাজনীতি, তা থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারবে কিনা। এক ধরনের সুযোগ আছে, যা আমাদের নিতে হবে। তবে ছাত্ররা প্রস্তুত। তারা প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা দেশজুড়ে লোকজনকে সংগঠিত করছে।’
এফপি/এমআই