চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রায় আড়াই লাখ মানুষের একমাত্র সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র। কিন্তু এখানে প্রতিদিন কয়েকশ রোগীর চাপ সামলাতে গিয়ে চিকিৎসক ও সেবাকর্মীরা পড়ছেন চরম বিপত্তিতে। ৫০ শয্যার এ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। ফলে অধিকাংশ রোগীকেই বহির্বিভাগের ওপর নির্ভর করতে হয়, আর ভর্তি হওয়া রোগীদের ঠাসাঠাসি অবস্থায় অস্বস্তিকর পরিবেশে থাকতে হয়। আবাসিক চিকিৎসক ডা. জসিম উদ্দিন বলেন, চাহিদার তুলনায় জনবল ও অবকাঠামো দুটোই অপ্রতুল। তবুও তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন ন্যূনতম চিকিৎসা দেওয়ার।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে চিকিৎসকের সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। অনুমোদিত ১০ জন চিকিৎসকের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ৭ জন। বিশেষজ্ঞ থাকার কথা ৭ জন হলেও বর্তমানে আছেন মাত্র ৪ জন। দুই মেডিকেল অফিসারের মধ্যে একজন ডেপুটেশনে থাকায় কার্যত একজনই দায়িত্ব পালন করছেন। ফলে অধীনস্থ চারটি সাবসেন্টার চিকিৎসকের পরিবর্তে স্বাস্থ্য সহকারীদের ওপর নির্ভর করছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় বহু রোগীকেই পাঠানো হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কিংবা বেসরকারি ক্লিনিকে। নার্স ও অন্যান্য কর্মীর ঘাটতিও গুরুতর।
শুধু জনবল নয়, যন্ত্রপাতির অবস্থাও শোচনীয়। দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালের এক্স-রে মেশিন বিকল হয়ে আছে। আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিনও অকেজো। এ কারণে রোগীদের মৌলিক পরীক্ষার জন্য বেসরকারি ক্লিনিকে ছুটতে হচ্ছে, যা বাড়াচ্ছে সময় ও খরচ- সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন নিম্নআয়ের মানুষ। স্থানীয়দের অভিযোগ, যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণে কর্তৃপক্ষের অবহেলা রয়েছে।
অন্যদিকে ভর্তি রোগীদের খাবারের মান নিয়েও ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। রোগীর স্বজনেরা অভিযোগ করেছেন, খাবার অপ্রতুল এবং মানসম্মত নয়। ডা. জসিম উদ্দিন জানান, সরকার প্রতিজন রোগীর জন্য দৈনিক মাত্র ১৪৫ টাকা বরাদ্দ করে, যা থেকে ভ্যাট ও ট্যাক্স কেটে নেওয়া হয়। এই টাকায় ভালো মানের খাবার দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তার ওপর ঠিকাদারদের মুনাফা কেটে নেওয়ায় খাবারের মান আরও কমে যায়। রোগীর স্বজনদের মতে, যদি মুনাফার হিসাব কমানো হয় তবে ওই বরাদ্দেই ভালো মানের খাবার সরবরাহ করা সম্ভব।
বহির্বিভাগের টিকিটের ক্ষেত্রেও অনিয়ম চলছে। রোগীদের কাছ থেকে ৩ টাকার টিকিটের বদলে ৫ টাকা নেওয়া হচ্ছে নিয়মিত। এতে মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকা এবং বছরে সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি বাড়তি আদায় হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ডা. জসিম উদ্দিন অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, সরকারি বরাদ্দের বাইরে যেসব খাতে টাকা প্রয়োজন, সেখানে এই বাড়তি অর্থ খরচ করা হয়। তবে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম এটিকে অনিয়ম আখ্যা দিয়ে জানিয়েছেন, অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
২০১৮ সালে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও নতুন কোনো ভবন নির্মাণ হয়নি। পুরনো ওয়ার্ডেই রোগীদের ঠাঁই দেওয়া হয়, অনেক সময় শয্যা না পেয়ে রোগীদের মেঝেতে থাকতে হয়। নতুন ওয়ার্ড ও ল্যাব সংস্কারের পরিকল্পনা কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে।
সব প্রতিকূলতার মাঝেও আশাবাদী হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক। ডা. জসিম উদ্দিন জানান, গত ৫ আগস্ট থেকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ অনেকটা কমেছে, ফলে কাজ করার পরিবেশ কিছুটা স্বস্তিদায়ক হয়েছে। তার আশা, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সচল করা গেলে এবং চিকিৎসক-নার্সসহ জনবল বাড়ানো হলে সাতকানিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রূপান্তর করা সম্ভব হবে।
আড়াই লাখ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র ভরসা এ হাসপাতালকে টিকিয়ে রাখতে তাই স্থানীয়রা সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। তাদের দাবি, গ্রামীণ জনগোষ্ঠী যেন ন্যূনতম চিকিৎসার জন্যও শহরে ছুটতে বাধ্য না হয়।
এফপি/রাজ