চট্টগ্রামের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রতিদিনই নতুন রেকর্ড গড়ছে। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, আলু, সবজি, মাছ ও মাংস- সব কিছুর দাম এখন যেন হাতের বাইরে চলে গেছে। বাজার করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ছে। খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষেরা তো বটেই, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মাসিক আয়-ব্যয়ের হিসাবও এলোমেলো হয়ে গেছে।
শহরের আগ্রাবাদ, কাজিরদেউরী বাজার, নতুন বাজার ও কর্ণফুলী মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, একেক জায়গায় একেক দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি ও খুচরা মূল্যের মধ্যে পার্থক্য কখনো দ্বিগুণ পর্যন্ত পৌঁছেছে। ব্যবসায়ীরা যে যার মতো করে দাম নির্ধারণ করছেন। এ অবস্থায় ভোক্তারা ক্ষুব্ধ, তবে তাদের বলার মতো কেউ নেই।
গৃহিণী সুমি আক্তার জানালেন, আগে যেখানে এক হাজার টাকায় পুরো সপ্তাহের বাজার হয়ে যেত, এখন সেই একই বাজার করতে তার খরচ হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষদের অবস্থাও আরও ভয়াবহ।
নগরীর একজন রিকশাচালক বলেন, দিনে আট-নয় শ টাকা আয় করেন, তার অর্ধেক চলে যাচ্ছে বাজার খরচেই। ফলে সংসারের অন্য খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
রিকশাচালক নুরুল আলম বলেন, “দিনে যা আয় করি, অর্ধেক চলে যায় বাজার খরচে। সংসার চালানোই দায় হয়ে গেছে।”
নগরীর আরেক সাধারণ ভোক্তা মিঠু আহমেদ বলেন, “সবকিছুর দাম এত বাড়ছে যে বাজার করা মানে যেন এক ধরনের জঞ্জাল। আমরা এখন হিমশিম খাইতে খাইতে প্রতিদিনের খাবারের হিসাব করি।”
চট্টগ্রামের আরেক ভুক্তভোগী, রফিকুল ইসলাম জানান, “আমি নিজে বাজারের নিয়মিত ক্রেতা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ব্যবসায়ীরা আমাদের ঠকাচ্ছে। অনেক সময় একই জিনিসের জন্য এক বাজারে বেশি, আরেক বাজারে কম দাম, এবং সরকারিকেও যেন এর কোনো প্রভাব নেই।”
অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা দায় চাপাচ্ছেন অন্যত্র। নিউ মার্কেটের এক খুচরা বিক্রেতা বলেন, “আমরা পাইকারি থেকেই বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছি। পরিবহন খরচ, ভাড়া, শ্রমিকের মজুরি সব মিলিয়েই দাম বাড়ছে।”
তবে ভোক্তা অধিকার কর্মীরা এ যুক্তি মানতে নারাজ। তাদের অভিযোগ, বাজারে সিন্ডিকেট তৈরি করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে অযৌক্তিক মুনাফার বোঝা।
সরকারি দপ্তরগুলোও এ বিষয়ে মুখ খুলেছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো.
কারুজ্জামান জানান, তারা নিয়মিত বাজার মনিটরিং করছেন এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অনেক ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়েছে। তবে শুধু অভিযানে সমস্যা সমাধান হবে না, জনগণকেও অভিযোগ জানাতে হবে এবং ব্যবসায়ীদেরও সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগের উপপরিচালক মো: আনিছুর রহমান বলেন, বাজারে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছে। এ ধরনের ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে যাতে বাজারের অস্থিরতা কাটিয়ে ওঠা যায়।
তবুও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। শহরের সচেতন মহল মনে করছেন, সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল। নিয়মিত মনিটরিং ও কঠোর পদক্ষেপের অভাবে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিচ্ছেন এবং ভোক্তাদের বিপদে ফেলছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অর্থনীতির অধ্যাপক বলেন, বাজারে সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে কেবল ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। সরবরাহ চেইন স্বচ্ছ রাখা এবং পণ্যের আমদানিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করলেই কেবল ভোক্তাদের কিছুটা স্বস্তি ফেরানো সম্ভব।
কিন্তু বাজারে যাওয়া সাধারণ মানুষরা এসব তত্ত্ব-তর্কে আর আশ্বস্ত হচ্ছেন না। তাদের অভিযোগ, প্রতিদিন বাজারে ঢুকলেই মনে হয় নতুন করে লুটপাটের শিকার হচ্ছেন। তারা জানতে চান- যদি সরকারের বাজার মনিটরিং এত সক্রিয় হয়, তবে কেন প্রতিদিনই নতুন দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে? জনগণের একটাই প্রশ্ন- এভাবে লাগামছাড়া বাজার চলতে থাকলে পরিবার চালাবে কিভাবে?
এফপি/রাজ