Dhaka, Friday | 14 March 2025
         
English Edition
   
Epaper | Friday | 14 March 2025 | English
আমাদের ওপর আক্রমণ করবেন না, কাজ করতে দেন: আইজিপি
শুক্রবার শপথ নেবেন কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি
মেয়ে ধর্ষণের শিকার, মামলার পর বাবা খুন
সাংবাদিকদের বেতন ৩০ হাজারের নিচে হলে পত্রিকা বন্ধ: প্রেস সচিব
শিরোনাম:

আমাজনের গহিনে মহুয়া রউফ, কেমন ছিলো অভিজ্ঞতা

প্রকাশ: শনিবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০২৫, ৩:৪৯ পিএম  (ভিজিটর : ৩৫)
মহুয়া রউফ। ছবি: সংগৃহীত

মহুয়া রউফ। ছবি: সংগৃহীত

মহাবন আমাজনে ঘুরতে গিয়েছিলেন মহুয়া রউফ। জঙ্গলে রাত কাটিয়েছেন, কাছ থেকে দেখেছেন কেইম্যান, নিয়েছেন আদিবাসীদের আতিথেয়তা। লিখলেন পাঁচ দিনের সেই অভিজ্ঞতা।

আমাজন নদী বেয়ে আদিবাসী তিকুনাদের একটি পাড়ায় এসে ভিড়ল নৌকা। বৈঠকখানার মতো খোলা বড়সড় একটি কক্ষ। পাতা আর পলিথিনের ছাউনি। সেই কক্ষে বসার সঙ্গে সঙ্গে শিঙায় ফুঁ দিলেন সমাজের কর্তাব্যক্তি। শুরু হলো নাচ। নৃত্যরত পুরুষদের নিম্নাঙ্গে পাতার ঝালর, বুক খোলা। নারীদের ঊর্ধ্বাঙ্গে পুঁতি আর পাখির পালকের মালা, নিম্নাঙ্গে পশমের ঘাগরা। যেন গ্রিক পুরানের নারী যোদ্ধা আমাজন।

একটার পর একটা নাচ চলতে থাকল। শেষ দিকে আমাকেও ডেকে নিল এক আদিবাসী পুরুষ। নির্দ্বিধায় তাঁর হাত ধরলাম।

একসময় অন্য দিকে দৃষ্টি যেতেই দেখি অ্যানাকোন্ডা গলায় জড়িয়ে আছেন একজন আদিবাসী। ভাবখানা এমন যেন পোষা বিড়াল। আরেকজন একটা শ্লথ বুকে জড়িয়ে আছেন, মাত্রই ঘুম ভেঙেছে কিন্তু আলসেমিতে চোখ খুলছে না। ভয়ে ভয়ে বুকে টানলাম।

আবার নৌকায় চড়ে বসলাম। চলতে চলতে আমাজনের আরেক ঘাটে ভিড়ল নৌকা। নদীর মধ্যখানে ঘাট। নদীর এই অংশ পিংক ডলফিনের অভয়ারণ্য। একটা মাছ দেখালেই লাফিয়ে ওঠে ডলফিন। শুনেছি, এখানটায় কেউ সাঁতার কাটলে পিংক ডলফিনও সঙ্গে সাঁতরায়। আটজনের দলে ভাগ হয়ে আমরা পানিতে লাফিয়ে পড়লাম।

দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা হলো ভাসমান রেস্তোরাঁয়। বিকেলে পিরারুকু মাছ ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে হোস্টেলে ফিরলাম। মাছ ধরব কীভাবে, এ মাছ যে মানুষের চেয়ে বড়!

এক দিনের এমন আমাজন দেখে পোষাল না। বনের আরও গভীরে গিয়ে রাত কাটানোর শখ হলো। হোস্টেলের ব্রেনোকে বলতেই সে বলল, তিন রাত চার দিনের একটি ভালো প্যাকেজ আছে। দুই রাত আমাজনের একটি লজে আর এক রাত জঙ্গলে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হবে।

পরদিন লজে পৌঁছালাম।

কেইম্যানের ভয়

বছর কুড়ি বয়সের একটা ছেলে এসে বলল, সে–ই গাইড। বললাম, তোমার নাম? বলল, বেবেথ।

বিকেলে বেবেথের কথামতো আমরা চার পর্যটক নৌকায় উঠে বসলাম। মামোরি লেক ধরে নৌকা চলছে। শান্ত, স্বচ্ছ পানিতে উঁচু লম্বা লম্বা ঘাস। একটা খাদের কিনারে এসে নৌকা থামল। এখানে দুই ভাগ হয়ে গেছে লেক—এক ভাগ খাড়া নিচের দিকে নেমে গেছে। স্রোত বেশি। বেবেথ ও আরেক গাইড এদেলসন কৌশলে নৌকা বাঁধলেন। হাত ধরে আমাদের একজন একজন করে লেকের পাড়ে নামালেন। পাড় এত বেশি পিচ্ছিল যে পড়ে যেতে যেতেও দলের চীনা সদস্য জোর সহায়তায় উঠে দাঁড়ালাম।

জঙ্গল ডিঙিয়ে কিছু দূর গেলেই পারানা নদী। পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। এ পাড়েও নৌকা বাঁধা আছে। খানিক পর নৌকা আমাদের আমাজনের এমন একটা অংশে নামিয়ে দিল, যেখানে ডলফিন আর পারানা মাছ বেশি। এখানে কাঠের চওড়া একটি ঘাট আছে। এ ঘাটেই আমাদের প্রথম অ্যাডভেঞ্চার—বড়শিতে পারানা মাছ ধরা আর ডলফিন দেখা।

বড়শিতে মুরগির এক টুকরা চামড়া গেঁথে পানিতে ফেললাম। প্রায় অর্ধশতবার বিফল হওয়ার পর শেষ মুহূর্তে ধরে ফেললাম একটা পিরানা। বড়শি থেকে ছাড়িয়ে মাছটাকে আবার পানিতে ছেড়ে দিলাম। সবাই তা-ই করেছে।

সূর্য ডুবে গেছে। মাছ ধরা শেষ করে আবার আমরা নৌকায় উঠে বসলাম। এখন শুরু হবে আরেকটি অ্যাডভেঞ্চার—ফ্ল্যাশ লাইট দিয়ে কেইম্যান খোঁজা। অন্ধকারে মামোরি লেকে ঘাসের ঝোপে লুকিয়ে থাকে কেইম্যান। দেখতে কুমিরের মতো। মোটামুটি নিশাচর এই প্রাণী দিনে কম দেখা যায়।

বেবেথের হাতে টর্চলাইট। ঘাসের ওপর তার আলো পড়তেই জ্বলজ্বল করে উঠল দুটি চোখ। ভয়ে পাশের জনকে যে জড়িয়ে ধরব, সে উপায়ও নাই। হাত-পা হিম হয়ে আসছে।

আমরা যখন কেইম্যান দর্শনে ব্যস্ত ঠিক তখনই একটা এসে আমাদের নৌকার পেছনের প্রান্তে ওঠার চেষ্টা করল। দেখেই ভয়ে পানির ওপর পুরু ঘাসে লাফ দিল জো। বেবেথ চিৎকার করে বলল, জলদি নৌকা চালাও, পেছনে আরেকটা কেইম্যান!

এদেলসন ইঞ্জিন স্টার্ট না দিয়েই জো–কে তুলে দাঁড় টানতে লাগল। আমার আর কিচ্ছু মনে নেই। কীভাবে বইঠা বেয়ে দুই গাইড লজ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে ভুলে গেছি।

ঘুমাতে যাওয়ার আগে বেবেথ বলল, রাতে কিন্তু পানি থেকে ডাঙায় উঠে আসে কেইম্যান। সাবধান!

লজের কাঠের মেঝে কোথাও কোথাও ফাঁকা। সারা রাত মনে হয়েছে এই বুঝি কেইম্যান এল!

মেরিলিন মনরোর পারফিউম

সকালে মামোরি লেক আর পারানা নদী পার করে হাঁটাতে হাঁটাতে শতবর্ষী দুটি গাছের তলায় নিয়ে গেল বেবেথ। বলল, বায়োডাইভার্সিটি ঠিক থাকলে এক হাজার বছর বাঁচবে এই গাছ। আদিবাসীরা বিশ্বাস করে, সামাউমা বা কপোকগাছের সঙ্গে স্বর্গের যোগ আছে। বর্ষায় পাশের লেকের পানিতে যখন আমাজনের এই অংশ ডুবে যায়, তখন পানি ধরে রেখে কপোক, শুষ্ক মৌসুমে প্রতিবেশী ছোট গাছেদের সরবরাহ করে।

একটু জিরিয়ে আরও গভীর জঙ্গলের দিকে হাঁটা শুরু করি। গাছের ঘন ছাউনিতে সূর্যের আলোও যেন আসতে ভয় পাচ্ছে। বাতাস ভারী এবং ভেজা। মাটি আর গাছপালার তাজা ঘ্রাণ আমাকে ঘিরে ধরেছে। আরও কিছুর অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। পাতার মর্মর, পাখির ডাক, দূর থেকে ভেসে আসা বানরের চিৎকার, আমাদের দেখে তার আরও ওপরের মগডালে ছুটে যাওয়া। আর অবিরাম পতঙ্গের গুঞ্জন—সে তো আমাজন সংগীত।

জঙ্গলটি যেন বেবেথের বাড়ি। সব চেনা। হাতের লম্বা দা দিয়ে লতা কেটে কেটে চলার পথ করে নিচ্ছে। একটা ঔষধি গাছের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, এই বৃক্ষের নির্যাস থেকে তৈরি হয়েছে মেরিলিন মনরোর পারফিউম!

বেবেথ বানরের মতো শব্দ করতেই ছুটে এল কয়েকটা বানর, আমাদের ক্যামেরার ফ্লাশের শব্দে দৌড়ে পালাল। একটা ছবিও তুলতে দিল না!

প্রতিটি পদক্ষেপে নতুন নতুন বিস্ময়ের মুখোমুখি হচ্ছি। বেবেথ একটা চিকন লাঠি মাকড়সার গর্তে ঢুকিয়ে দিতেই সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসছে মাকড়সা। লুকিয়ে থাকা পোকামাকড় আর বন্য প্রাণীদের বের করে আনার সব কৌশল তাঁর জানা। আকাশছোঁয়া কপোকগাছ, কখনো কখনো দেখা পাচ্ছি নীল প্রজাপতি, যারা সূর্যের অল্প আলোয় ঝিকমিক করছে, আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে রঙিন ম্যাকাউ। ছবি তোলার অবসরটুকু দিচ্ছে না। অদূরে বনের মধ্য দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী।

গরম আর রেইনফরেস্ট—এই দুই মিলে ঘেমে যাচ্ছি। আর মশার ঝাঁকের কথা কী বলব? ওর রাজ্যে যেহেতু ঢুকেই পড়েছি, সহ্য তো করতেই হবে।

ট্রেকিং শেষ করে লজে ফিরে দুপুরের খাবার খেলাম। আজ ক্যাম্পফায়ার আর বন্য পরিবেশে নিশিযাপন।


রাতের আমাজন

তৈরি হয়ে আবারও ট্রেকিং করে লজ থেকে আরেক অংশে পৌঁছে গেলাম।

ভেজা লাকড়িতে আগুন ধরানোর চেষ্টা চলছে। রাতে যে ঝুলবিছানায় ঘুমাতে হবে, ব্রাজিলিয়ানরা সেগুলোকে বলে হেইজি। জঙ্গলে পলিথিন দিয়ে একটা ছাউনির মতো আগে থেকেই করা ছিল। তার নিচে পাঁচটি ঝুলবিছানা বাঁধল এদেলসন। দুই গাইডসহ আমরা পাঁচজন।

ভেজা লাকড়িতেই আগুন বেশ ভালো জ্বলছে। এরা সব কায়দাকানুন জানে। আশপাশের গাছের ডাল কেটে এনে বানানো হলো খাবার টেবিল। কলাপাতা কেটে টেবিলের ওপর বিছিয়ে দিল। চুলায় ভাত চড়ালাম। আগুনে ঝলসানো হবে মাংস। এদেলসন গাছের ডাল চেঁচে চেঁচে তৈরি করল পাঁচটি নিখুঁত চামচ। পাতা দিয়ে একরকম ঠোঙার মতো তৈরি হলো, যেটি প্লেটের কাজ করবে। সব মিলিয়ে এক আদিম পরিবেশ।

চারদিকে শত শত নাম না জানা পোকামাকড়ের গুঞ্জন। বেজেই চলছে।

সূর্যাস্তের পর সম্পূর্ণ অন্য এক রূপ নিল আমাজন। অন্ধকারে জোনাকির আলো আর নানা প্রাণীর গুঞ্জন এক রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করল। রাতের আমাজন আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন জগৎ। গভীর রাতে ক্যাম্পফায়ারের লাল-কমলা আলো চারপাশে উষ্ণতা ছড়াচ্ছে আর সেই সঙ্গে ভেসে আসছে কাঠ পোড়ার গন্ধ। আকাশে তারা নেই, অন্ধকার কিন্তু জীবন্ত পরিবেশ।

খাওয়াদাওয়ার পর ঝুলন্ত বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মশারি দিয়ে বিছানা ঢেকে দিল বেবেথ। পাঁচজনের মধ্যে নিজেকে মনে হচ্ছে খুব নিঃসঙ্গ।

এফপি/এমআই
বিষয়:  আমাজন জঙ্গল   মহুয়া রউফ  
সর্বশেষ সংবাদ  
সর্বাধিক পঠিত  
YOU MAY ALSO LIKE  
Editor & Publisher: S. M. Mesbah Uddin
Editorial, News and Commercial Offices: Akram Tower, 15/5, Bijoynagar (9th Floor), Ramna, Dhaka-1000
Call: 01713-180024, 01675-383357 & 01840-000044
E-mail: [email protected], [email protected]
🔝