নদীর বুকেও গজায় ফসল এ যেন শুধু কল্পনা নয়, বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে যশোরের কেশবপুর উপজেলার মধ্যকুল গ্রামের প্রবীণ কৃষক নীলরতন দাস এর হাতে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও তিনি যে উদ্যম, নতুন ভাবনা ও অক্লান্ত শ্রমে কৃষিকে আঁকড়ে ধরেছেন, তা শুধু প্রশংসনীয় নয় বরং দেশের অন্য কৃষকদের জন্য এক অনুপ্রেরণার নাম।
হরিহর নদীর জলে ভেসে থাকা বাঁশ, খড় ও কচুরিপানা দিয়ে তৈরি ভাসমান বেডে তিনি বছরের পর বছর ধরে চাষ করছেন লতিরাজ (কচুর লতি)। স্থানীয় বাজারে এই লতি বিক্রি করে প্রতিবছর আয় করছেন লক্ষাধিক টাকা। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও, চাষের উৎসাহে তিনি এখনো তরুণদের চেয়ে কোনো অংশে কম নন।
নীলরতন জানান, ‘পানি তো আমাদের চারপাশে সবসময়ই ছিল। আগে বন্যা আসলে শাকসবজি নষ্ট হয়ে যেত। পরে ভাবলাম, জলেই যদি চাষ করা যায়? তখনই শুরু করি এই ভাসমান বেডের উপর লতিরাজ চাষ।
এই পদ্ধতিতে জমি লাগে না, লাগে শুধু কৌশল আর নিষ্ঠা। নদীর উপর কচুরিপানা, খড়কুটো, বাঁশের মাচা দিয়ে তৈরি করা হয় ফ্লোটিং বেড। তার ওপর পাতার সার দিয়ে চারা রোপণ করা হয়। বৃষ্টির দিনে পানির উচ্চতা বেড়ে গেলেও ক্ষতি হয় না, বরং বেড নিজেই ভেসে বেড়ায়।
তিনি জানান, একেকটি মৌসুমে প্রায় ২০-২৫টি ভাসমান বেড তৈরি করেন। প্রতিটি বেড থেকে গড়ে ৪০-৫০ কেজি কচুর লতি পাওয়া যায়। প্রতি কেজি বাজারে বিক্রি হয় ৩০-৩৫ টাকা দরে, কখনো কখনো আরও বেশি।
বর্তমান সময়ে যেখানে কৃষি জমির পরিমাণ কমছে, সেখানে ভাসমান কৃষি প্রযুক্তি হতে পারে এক বিকল্প দিগন্ত। বিশেষ করে জলাবদ্ধতা ও খাল-নদীপ্রবণ অঞ্চলে বসবাসকারী কৃষকরা এর মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হতে পারেন।
স্থানীয় কৃষি অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘নীলরতন দাস এই অঞ্চলে এক ধরনের মডেল কৃষক। তাঁর ভাসমান বেড পদ্ধতিতে লতিরাজ চাষ শুধু টেকসই নয়, পরিবেশবান্ধবও। এটি অন্যদের মাঝেও ছড়িয়ে দিতে আমরা কাজ করছি।
নীলরতন দাসের জীবনের গল্প নিছক একজন কৃষকেরই নয় বরং এটি জল, মাটি ও প্রাণের সাথে লড়াইয়ের এক সাহসী কাহিনি। তিনি বলেন, ‘কোনোদিন স্কুলে যাইনি। কিন্তু প্রকৃতিকে দেখেই শিখে গেছি কিভাবে কাজ করতে হয়। একদিন হঠাৎ নদীতে কচুর লতি গজাতে দেখে মনে হলো এটাকে তো চাষ করা যায়!
তখন থেকে শুরু। নিজের চিন্তায়, নিজের পরিশ্রমে নদীর জলে গড়ে তোলেন সবুজ ক্ষেত। আজ তিনি নিজেই বলেন, ‘সকাল হলে হাঁটুর জলে নেমে পড়ি। দুপুরে ফেরার সময় সাথে নিয়ে আসি লতিরাজ। এই নদী, এই লতি এখন আমার সাথী’।
নীলরতনের ভাষ্যমতে, ভাসমান বেড তৈরি করতে খড়কুটো, কলাগাছের গোঁড়া, বাঁশের খাঁচা এবং কচুরিপানা একত্র করে তার উপর লতিরাজ চারা বসানো হয়। ৫-৬ দিন পরই চারা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। এক মাসের মধ্যে কচুর লতি সংগ্রহযোগ্য হয়। বর্ষা মৌসুমে পানি বাড়লেও ভেসে থাকা বেডগুলোর কোনো ক্ষতি হয় না। বরং উর্বরতা বাড়ে। বেড প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার লতি তোলা যায়। প্রতি মৌসুমে (জুলাই-অক্টোবর) নীলরতনের আয় হয় প্রায় লক্ষ টাকা।
ছবিতে দেখা যায়, নীলরতন কাকা দাঁড়িয়ে আছেন একটি ডিঙি নৌকায়। হাতে একটি বাঁশের লাঠি- যেন এক কৃষি-অভিযাত্রীর প্রতীক। পেছনে ভাসমান কচুর ক্ষেত। বয়স তার মুখে ভাঁজ ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু চোখে-মুখে সেই চিরন্তন কৃষকের গর্ব। তিনি বলেন, জীবন থেমে গেলে চলে না। মাটি না পাইলেও নদী তো আছে! এই নদীতেই তো আমার ক্ষেত।
মধ্যকুল গ্রামের এই বৃদ্ধ কৃষকের কথা এখন স্থানীয় মহলে আলোচিত। অনেক তরুণও তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন। কেউ কেউ নতুন করে ফ্লোটিং বেড তৈরি করে চাষ শুরু করেছেন।
স্থানীয় ইউপি সদস্য শাহানাজ পারভীন বলেন, ‘নীলরতন দাস শুধু একজন চাষি নন, তিনি আমাদের অঞ্চলের প্রেরণা। কৃষিকে ভালোবাসলে, নদীকেও আপন করা যায় তিনি তা প্রমাণ করেছেন। বাংলাদেশের মাটি শুধু নয়, জলও পারে জীবন গড়তে সেটি প্রমাণ করলেন কেশবপুরের নীলরতন দাস। তাঁর লতিরাজ আজ শুধু তার রোজগারের উৎস নয়, বরং দেশের বিকল্প কৃষি ভাবনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
এফপি/রাজ