জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে এসে দেশের আমদানি-রফতানি, শিল্প উৎপাদন ও রাজস্ব আহরণ কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রাম, বেনাপোল, আখাউড়া, ভোমরা, বুড়িমারী ও হিলি-সব বন্দরেই কাস্টমস কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আটকে গেছে পণ্যবোঝাই হাজার হাজার ট্রাক ও কনটেইনার। শুধু চট্টগ্রাম বন্দরে ৩৬৮০টি রফতানি কনটেইনার আটকে থাকার তথ্য নিশ্চিত করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অচলাবস্থায় প্রতিদিন গড়ে ২৫০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। যার এক-তৃতীয়াংশ সরাসরি রফতানি ও আমদানি কার্যক্রমে। ইতোমধ্যে দুই দিনে ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়েছে প্রায় ৫০০০ কোটি টাকা।
এনবিআরের আওতায় কাস্টমস, ভ্যাট ও কর অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ১২ মে সরকারের দেওয়া একটি গেজেটের প্রতিবাদে এই কর্মবিরতি শুরু করেন। ওই গেজেটের মাধ্যমে এনবিআর বিলুপ্ত করে দুটি নতুন বিভাগ-‘রাজস্ব নীতি’ ও ‘রাজস্ব প্রশাসন’-গঠন করা হয়। এতে কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর ক্যাডার কর্মকর্তারা প্রশাসন ক্যাডারের অধীনস্থ হয়ে পড়েন বলে দাবি উঠেছে। রাজস্ব ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলছেন, এই পরিবর্তন তাদের মর্যাদা, পদোন্নতি ও স্বায়ত্তশাসনের ওপর সরাসরি আঘাত।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, পোশাক শিল্পের পণ্যসহ প্রায় ৩৭০০ কনটেইনার এখন বন্দরে আটকে। তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, প্রতিদিন গড়ে ২৫০০–২৬০০ কোটি টাকার কার্যক্রম থেমে যাচ্ছে, বিদেশি ক্রেতারা চুক্তি বাতিলের হুমকি দিচ্ছেন।
আখাউড়া, বেনাপোল ও ভোমরায়ও থেমে গেছে ট্রাক চলাচল। বেনাপোলে আটকে আছে ৮০০-এর বেশি ট্রাক, যার বেশিরভাগই ভারতের পেট্রাপোল সীমান্তে অপেক্ষমাণ।
ভোমরা স্থলবন্দরে প্রতিদিন এক কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হলেও গত দুই দিনে প্রায় দুই কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়নি। বন্দরে থাকা শত শত ট্রাক পণ্য খালাসের অপেক্ষায় আছে, কাস্টমস কর্মকর্তারা অনুপস্থিত থাকায় কোনও কার্যক্রমই হচ্ছে না।
মেট্রোপলিটন চেম্বার, বিসিআই ও এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠন এ পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে। মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, ‘‘কাঁচামাল না এলে শিল্প থেমে যাবে, কর্মসংস্থান হুমকিতে পড়বে, বাজার হারানোর আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।’’
সরকার ইতোমধ্যে এনবিআরের অধীনস্থ সব দপ্তরকে ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এক সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘জাতীয় স্বার্থে কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাজে ফেরাতে বাধ্য হতে হবে, না হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
জুন মাস রাজস্ব আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সময়। কিন্তু আন্দোলনের কারণে প্রতিদিন গড়ে ২০০–২৫০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় কম হচ্ছে। অর্থনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি বলছে, এই সংকট দীর্ঘ হলে বাজেট বাস্তবায়ন, উন্নয়ন ব্যয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সবই চাপে পড়বে।
২৯ জুন বিকেলে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য আলোচনা বৈঠক শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়। অর্থ উপদেষ্টা জানান, ‘আন্দোলন চলাকালে কোনও বৈঠক সম্ভব নয়।’ ফলে ১ জুলাই নির্ধারিত পরবর্তী বৈঠক নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে আন্দোলনরত কর্মকর্তারা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘চেয়ারম্যান অপসারণ ও বিলুপ্তি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। সরকার একতরফাভাবে ‘অত্যাবশ্যকীয়’ ঘোষণা দিয়ে আমাদের দাবিকে দমন করতে পারবে না।’’
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংকট দ্রুত সমাধান না হলে দেশের অর্থনীতি বহুমাত্রিক অভিঘাতে পড়ে যাবে। রফতানির বিপর্যয় মানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ। রাজস্ব ঘাটতি মানে বাজেট বাস্তবায়নে ব্যাঘাত। আর দীর্ঘমেয়াদে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থার ওপর বড় ধাক্কা।
তাদের মতে, সংকট সমাধানে এখন প্রয়োজন পরিপক্বতা, সংলাপ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। একপক্ষের অনমনীয়তা ও অন্যপক্ষের জিরো টলারেন্স-দুই মিলে সংকটকে আরও গভীর করে তুলছে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
এফপি/রাজ