কোন এক অদৃশ্য শক্তির কারণে কক্সবাজারে ঈদগাও উপজেলার কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের অধিনে ঈদগাও রেঞ্জে মোট ১৮টি অবৈধ করাতকল চলমান রয়েছে।
বিভাগীয় বন বর্কমর্কতা ঈদগাও রেঞ্জ কর্মকর্তাকে এব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে চিঠি প্রেরণ করা হলে সেই চিঠির স্মারক উল্লেখ করে অবৈধ করাতকল মালিকদের চিঠি ইস্যু করে গত মাসে। অবৈধ করাতকল মালিকরা চিঠি পাওয়ার পরেও করাতকল না সরালে বন সংরক্ষক চট্টগ্রাম, বিবভাগীয় বন কর্মকর্তার চিঠির স্মারক উল্লেখ করে গত ৩০ ডিসেম্বর অবৈধ করাতকল মালিকদের চিঠি প্রদান করে এবং ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত করাতকলের কাগজপত্র হালনাগাদ করার সুযোগ দিয়ে চিঠি ইস্যু করে ঈদগাও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিমল চাকমা।
গত ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত উপজেলা প্রশাসন থেকে আলটিমেটাম দিলেও আজ পর্যন্ত এই অবৈধ করাতকলের বিরোদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেননি কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগ ও ঈদগাও উপজেলা প্রশাসন। এটিকে বাঁকা চোখে দেখছে স্থানীয় সচেতন মহল। তারা মনে করছেন এই করাতকল মালিকরা তাদের করাতকল চারাতে কোন না কোনভাবে প্রশাসন ম্যানেজ করে চালিয়ে যাচ্ছে। যদি এমন না হয়ে থাকলে গত মাসের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আলটিমেটাম দেওয়া হলেও এরপর কোন পদক্ষেপ নেননি সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
এদিকে উপজেলা প্রশাসন বলছে, চিঠি ইস্যু করার পর কারতকল মালিকরা নিজ থেকে করাতকল উঠিয়ে নিয়েছে। কিন্তু মাঠের চিত্র ভিন্ন দেখা গেছে। হরদম চলছে করাতকল বিশেষ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অফিসের সাথে লাগোয়া ও ভরা বাজারে এসব করাতকল চলমান রয়েছে এমনটা দেখা গেছে।
এদিকে অভিযোগের মুখে কয়েকদিনে নামমাত্র উপজেলা প্রশাসন থেকে অভিযান পরিচালনা করা হলেও এখনো চলমান অবৈধ করাতকল। প্রশাসনের চোখের সামনে এই করাতকলগুলো চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে। লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে করাতকল রেখে দেওয়া ও সাময়িক বন্ধ রেখে আবারো করাতকলগুলোকে চালু করার সুযোগ দেওয়াকে ভিন্ন চোখে দেখছে স্থানীয় সচেতন মহল। যার কারণে কক্সবাজারের ঈদগাও উপজেলাতে স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে সরকারি জমিতে অবৈধ করাতকল বসিয়ে দিনের পর দিন বনের গাছ নিধন প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে স্থানীয়রা।
প্রাণ প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় সম্প্রতি (২০ অক্টোবর ) ইসলামাবাদ ইউনিয়ের প্রবাসি আজিজুর রহমান জেলা প্রশাসক বরাবর ঈদগাও বাজারের বাঁশঘাটা এলাকায় অবৈধ করাতকল উচ্ছেদ করতে আবেদন করেন।
আজিজুর রহমান জানান, আমি প্রবাসি জীবন যাপন করি। দেশে আসার পর দেখলাম আমার বাড়ির যাতায়াত পথে বাশঘাটা ব্রিজের পাশে দুটি করাতকল রয়েছে যা পরিবেশ প্রকৃতি ও শব্দদূষণ হয় বেশি। করাতকল দুটোর মালিক ইসলামাবাদ ইউনিয়নের মৃত ফেরদৌস এর ছেলে হুমায়ন কবির ও মৃত আমিন শরীফ এর ছেলে জিয়াবুল ইসলাম বাবুল। তারা ঈদগাও বাজারের মতো এলাকায় অবৈধভাবে করাতকল বসিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। আশা করছি আমার আবেদন জেলা প্রশাসন আমলে নিবেন।
জানা যায় কক্সবাজারে ঈদগাও উপজেলাতে বিভিন্ন জায়গায় ১০ থেকে ১২টি অবৈধ করাতকল বিভিন্ন জনের নামে চলছে। কিন্তু করাতকল স্থাপনে লাইসেন্স নিতে হয় বন বিভাগ থেকে। লাগে পরিবেশ অধিদপ্তরে ছাড়পত্র। মানতে হয় আরও নির্দিষ্ট কিছু বিধিমালা। কক্সবাজারে এসবের কোনো তোয়াক্কা নেই বললেই চলে। নিয়ম-নীতি না মেনে যত্রতত্র গড়ে উঠছে অবৈধ করাতকল। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আশপাশের এলাকা ঘিরে গড়ে ওঠা এসব করাতকলে হরহামেশা চেরাই করা হচ্ছে কাঠ। এতে উজাড় হচ্ছে বনাঞ্চল। ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের।
স্থানীয়দের অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এসব করাতকল পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে যত্রতত্র অবৈধ করাতকল স্থাপনের বিষয়টি সম্প্রতি কয়েকটি যৌথ অভিযান পরিচালনার কথা জানিয়েছেন বনবিভাগের ঈদগাও রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ আনোয়ার হোসেন।
এদিকে করাতকল বিধিমালা-২০১২ তে বলা আছে, কোনো সরকারি অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিনোদন পার্ক, উদ্যান ও জনস্বাস্থ্য বা পরিবেশের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে এমন স্থান থেকে কমপক্ষে ২০০ মিটার এবং সরকারি বনভূমির সীমানা থেকে কমপক্ষে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপন করা যাবে না। এই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না কোথাও। এখন ঘনবসতি এলাকা ঈদগাও বাজারে বেশ কয়েকটি করাতকল থাকার কারণে বাজারে আসা ও বাজার ব্যবসায়ীরা শব্দদূষণসহ বেশ সমস্যায় রয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার সভাপতি ও জনকন্ঠের স্টাফ রিপোর্টার এইচএম এরশাদ জানান, এই করাতকলের মাধ্যমে প্রাণ প্রকৃতি নষ্ট হচ্ছে। এই করাতকল ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে গাছ কাটার ফলে প্রাণী জগতের অনেক প্রভাব পড়ছে । আশা করছি প্রশাসন আইনগত ব্যবস্থা নিবে। বনবিভাগের চট্রগ্রাম অঞ্চল থেকে চিঠি আসার পরেও এখনো করাতকল সরানো হয়নি। যার কারণে পরিবেশ কর্মীরা হতাশ।
জানা যায়, কক্সবাজারের ঈদগাঁওর বিভিন্ন এলাকায় সরকারের অনুমোদন ছাড়াই প্রায় অর্ধশত করাত কল চলছে রমরমা অবৈধ ব্যবসা। এসব মিলে সাবাড় হচ্ছে বনজ, ফলজসহ নানা প্রজাতির গাছ। অনুমোদনহীন এসব করাত মিল থেকে বিভিন্ন প্রশাসনের কাছে মাসিক মাসোহার দেন বলে জানা গেছে।
জানা যায়, বিভিন্ন বনাঞ্চলের হরেক প্রজাতির কাঠ গিলে খাচ্ছে কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ঈদগাঁও’র স্থাপিত অবৈধ করাত কলগুলো দিবারাত্রি চিরাই হচ্ছে বনাঞ্চলের কাঠ। এসব গাছ রাতের আধারে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে এনে চিরানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কয়েকটি স’মিলের বিরুদ্ধে শব্দ দূষণ আইন অমান্য করে ভোর ৬টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান,কয়েকটি করাতকলে দিন-রাত ২৪ ঘন্টা কাঠ চেরাই হওয়ায় স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এদিকে দীর্ঘদিন যাবত বনবিভাগ কিংবা সংশ্লিষ্টদের কোন ধরণের অভিযান পরিচালিত না হওয়ায় এলাকাবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, এসব করাত কলের মালিকানায় কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি থাকায় সহজে উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না।
ঈদগাও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুবল চাকমা জানান, গতকালও অভিযান পরিচালনা করে তাদের জনিমানা করা হয়েছে। করাতকল বসানোর বিধিমালা রয়েছে। আমার উপজেলায় যদি অবৈধ করাতকল থাকে তাদের বিরোদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কক্সবাজার জেরা প্রশাসক মোঃ সালাহ উদ্দিন জানান, অবৈধ করাতকল অবশ্যই উচ্ছেদ করা হবে। অবগত হয়েছি এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার হবে।
বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ২১২টি করাতকলের মধ্যে চকরিয়া ৩৯, পেকুয়াতে ১৮, সদর উপজেলায় ৩৩, টেকনাফে ২২, রামুতে ২৬, কুতুবদিয়ায় ১৩, মহেশখালীতে ২১ ও উখিয়ায় ৪০টি রয়েছে। এসব করাতকলের কোনোটির পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। ১৭টি করাতকলের বন বিভাগের লাইসেন্স থাকলেও ইতিমধ্যে তা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটারের ভেতরে করাতকল স্থাপনের নিয়ম না থাকলেও ৯০ শতাংশ করাতকল স্থাপন করা হয়েছে বনাঞ্চলের আশপাশে।
ঈদগাও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিমল চাকমা জানান, আমরা অবৈধ করাতকল মালিকদের চিঠি দিয়েছি তাদের কাগজ হাল নাগাদ করার জন্য। তারা চিঠি পেয়ে অনেকেই করাতকল উঠিয়ে ফেলেছিল। এখন শোনা যাচ্ছে তারা আবার করাতকল বসিয়েছে । আশা করছি শীগ্রই অভিযান পরিচালনা করা হবে।
এফপি/রাজ