রাজধানীর মিরপুরে একটি মোটরসাইকেল গ্যারেজে ‘মজার ছলে’ পায়ুপথে কম্প্রেসার মেশিনের বাতাস ঢুকিয়ে চার বছরের শিশু আবু বকর সিদ্দিককে হত্যা করা হয়েছে।
আবু বকর ‘ফুলকলি-৭’ নামক একটি এনজিও-চালিত স্কুলে পড়ত। তার বাবা বাসচালক, মা পোশাক কারখানার কর্মী। পারিবারিক সমস্যার কারণে সে মায়ের সঙ্গে মিরপুরের বাউনিয়া বাঁধ এলাকায় থাকতো। মাঝে মাঝে যেত বড় ভাই জিহাদের কর্মস্থলে-‘আলহামদুলিল্লাহ বাইক সার্ভিস সেন্টারে’। গত সপ্তাহে জিহাদের অনুপস্থিতিতে সহকর্মীরা আবু বকরকে হত্যা করে।
পুলিশ জানায়, শিশুটিকে গ্যারেজের কমপ্রেসার মেশিন দিয়ে পায়ুপথে বাতাস প্রবেশ করানো হয়। প্রচণ্ড চাপের ফলে তার শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। ২০১৫ সালে খুলনায়, ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জে এবং ২০২২ সালে গাজীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় একই কায়দায় শিশুহত্যার নজির রয়েছে। কম্প্রেসার মেশিনের গ্যাস দিয়ে শিশু নির্যাতনের মতো ঘটনা বারবার ঘটলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবে অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী, ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুকে শ্রমে নিয়োগ দেওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তবু রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরের গ্যারেজ, ওয়ার্কশপ ও সিএনজি ফিটিং কারখানায় শিশুদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের ২০২২ সালের জরিপে জানা যায়, দেশে প্রায় ৩৫ লাখ শিশু কোনো না কোনোভাবে শ্রমে নিয়োজিত। এর মধ্যে প্রায় ১০ লাখ শিশু বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত।
এই শিশুরা সাধারণত দিনে কাজ করে, রাতে স্কুলে যায় বা একসময় স্কুল ছেড়েই দেয়। কাজ শেখে দ্রুত, মজুরি কম নেয়, অভিযোগ করে না- এ কারণেই ওয়ার্কশপ মালিকদের কাছে তারা পছন্দের শ্রমিক।
মিরপুরের একটি গ্যারেজে কাজ করে ১৫ বছরের শাহরিয়ার জয়। সে বলে, “শুরুতে ভুল করলেই মার খেতে হতো। এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি।” জয় স্কুলে পড়লেও দৈনিক কাজ করে ৭-৮ ঘণ্টা। তার আয়ের ওপর নির্ভর করে পরিবার।
এমনই আরও শিশুরা কাজ করছে দেশের হাজার হাজার গ্যারেজে, কারখানায়। কেউ বাবা-মার চাপে, কেউ নিজের ইচ্ছায় পরিবারে সহায়তা করতে গিয়ে।
সেভ দ্য চিলড্রেন-এর শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, “গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপগুলো ইনফরমাল সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় নিয়মিত নজরদারি নেই। ফলে আইন প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়।”
তিনি আরও বলেন, “অভিভাবকরা অনেক সময় শিশুদের কাজ শেখাতে এসব জায়গায় পাঠান। ওয়ার্কশপ মালিকদেরও দায়িত্ব নিতে হবে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সমস্যা সমাধানে কেবল আইন প্রয়োগ নয়, দরকার সচেতনতা, সামাজিক জবাবদিহিতা এবং দরিদ্র পরিবারের জন্য বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টি।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের সভাপতি ড. হামিদুল হক বলেন, “শ্রেণিভেদে শিশুদের মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে। দরিদ্র শিশুরা শ্রমিক হয়ে ওঠে, সম্ভাবনা হারায়।”
তিনি মনে করেন, সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে শিশুশ্রম বন্ধে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সুনির্দিষ্ট নজরদারি, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, নিরাপদ ডে কেয়ার কেন্দ্র এবং শিক্ষামুখী প্রণোদনা না থাকলে এই চক্র ভাঙবে না।
চার বছরের আবু বকর আর নেই। কিন্তু তার মৃত্যু যেন শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে জাতিকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
এফপি/রাজ