ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে অতি ঝুঁকিপূর্ণ (লাল চিহ্নিত) ও ঝুঁকিপূর্ণ (হলুদ চিহ্নিত) সব ভোটকেন্দ্রে বডিঅর্ন ক্যামেরা (বডিক্যাম) রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। প্রতিটি থানার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েন করবে। এ ছাড়া পাঁচটি কেন্দ্রের জন্য একটি করে মোবাইল টিম মোতায়েনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ যত এগিয়ে আসছে, ভোটকেন্দ্রসহ সুষ্ঠু ভোটের জন্য নিরাপত্তা পরিকল্পনা সাজানোর কাজও এগিয়ে নিচ্ছে পুলিশ। সেই সঙ্গে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হচ্ছে দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে। ইতোমধ্যে এক লাখ ৭ হাজার ৫৮২ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যকে নির্বাচনী প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, ভোটকেন্দ্রে মোতায়েনের জন্য বর্তমানে ২৫ হাজার বডিঅর্ন ক্যামেরা কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পুলিশের কাছে বর্তমানে ১০ হাজার ক্যামেরা রয়েছে। ইতোমধ্যে বডিঅর্ন ক্যামেরা পরিচালনার প্রশিক্ষণও শেষ পর্যায়ে। নতুন যে ২৫ হাজার ক্যামেরা কেনা হচ্ছে তাতে এআই ফিচার থাকছে না বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। তবে ব্যাকএন্ডে অর্থাৎ পুলিশের কমান্ড সেন্টার বা কন্ট্রোল রুমের প্ল্যাটফর্মে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) খন্দকার রফিকুল ইসলাম গতকাল বলেন, ভোটের নিরাপত্তায় নানা আয়োজন এগিয়ে নিচ্ছে পুলিশ। অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের নিরাপত্তায় তারা বিশেষ নজর দিচ্ছেন। এ ধরনের কেন্দ্রে বডিঅর্ন ক্যামেরা মোতায়েন করা হবে। তিনি বলেন, পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা পরিকল্পনাও আপডেট করা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সারাদেশে মোট ভোটকেন্দ্র ছিল ৪২ হাজার ১৪৮টি। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন থেকে মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৪২ হাজার ৭৬১টি বলে উল্লেখ করা হয়। গতকাল পর্যন্ত হিসাবে দেখা গেছে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা আরও ৮টি বেড়েছে। এ ছাড়া এ মাসের শুরুতে পুলিশের পক্ষ থেকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের সংখ্যা ৮ হাজার ৭৪৬টি, ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১৬ হাজার ৩৫৯টি এবং সাধারণ ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১৭ হাজার ৬৫৬টির কথা বলা হয়। কিন্তু গতকাল পুলিশ সদর দপ্তর থেকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ মোট ভোটকেন্দ্রের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে তাতে দেখা গেছে, অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৮ হাজার ৭৭০টি, ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১৬ হাজার ৬৭৫টি এবং সাধারণ ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১৭ হাজার ৩২৪টি।
সূত্র জানিয়েছে, সারাদেশে মোট ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের সংখ্যাই বেশি। এই ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় নির্বাচন কমিশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তর সর্বোচ্চ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাগ্রহণের পরিকল্পনা নিয়েছে। যে কোনো ধরনের গোলযোগ এড়াতে এসব কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জনবল বেশি নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এসব কেন্দ্রে নজরদারিও বেশি থাকবে। সারাদেশের মধ্যে ঢাকাতেই (ঢাকা বিভাগ ও ঢাকা মহানগর মিলে) ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আর জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র চট্টগ্রাম জেলায়।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে ৩ জন অস্ত্রধারী পুলিশ, অস্ত্রসহ ২ জন আনসার সদস্য এবং লাঠি হাতে ১০ জন আনসার মোতায়েনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া থাকবে গ্রামপুলিশ। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ২ জন অস্ত্রধারী পুলিশ, ২ জন অস্ত্রধারী আনসার সদস্য, লাঠি হাতে ১০ জন আনসার সদস্য এবং গ্রামপুলিশ মোতায়েন থাকবে। এসব কেন্দ্রে বডিঅর্ন ক্যামেরাসহ পুলিশ মোতায়েন করা হবে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ভোটকেন্দ্রে হঠাৎ উত্তেজনা, বিশৃঙ্খলা, সংঘাত, হঠাৎ দৌড়ঝাঁপ, কেন্দ্র দখল, মারামারি বা অস্বাভাবিক আচরণ, অস্ত্র প্রদর্শন বা অন্য যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ভিডিও ও অডিও রেকর্ড করবে বডিঅর্ন ক্যামেরা। এসব ঘটনা বডিঅর্ন ক্যামেরার নজরে আসামাত্র পুলিশ কন্ট্রোল রুমে সংকেত যাবে। সে অনুযায়ী পুলিশের দায়িত্বশীলরা বাড়তি নিরাপত্তার প্রয়োজন হলে সে ব্যবস্থা নিতে পারবে। এ ছাড়া ব্যালট বাক্স ও ভোটের সামগ্রী পরিবহনকালে পথে হামলা, ছিনতাই বা ভাঙচুরের ঘটনা হলে সেই সংকেতও পাবে পুলিশ কন্ট্রোল রুম বা কমান্ড সেন্টার। পাশাপাশি এসব ঘটনার প্রমাণাদি তাৎক্ষণিক সংরক্ষণ করা যাবে, যা পরবর্তীকালে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে কাজ করবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, ভোটপূর্ব সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, ভোটার ভয়ভীতি বা অপকর্ম নিয়ে বিতর্ক হলে বডিঅর্ন ক্যামেরার ফুটেজ নির্ভরযোগ্য প্রমাণ হিসেবে কাজে দেবে। অনেক দেশ ভোটসংক্রান্ত মামলায় বডিক্যাম ভিডিও ব্যবহার করে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করছে।
সারাদেশের ভোটের কেন্দ্রগুলোকে লাল (অতি ঝুঁকিপূর্ণ), হলুদ (ঝুঁকিপূর্ণ) ও সবুজ (সাধারণ) তিন ভাগে ভাগ করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রের ভোটার সংখ্যা, থানা থেকে দূরত্ব, রাজনৈতিক দলের আধিপত্য, পাহাড়ি এলাকা, দুর্গম এলাকা এবং ও চরাঞ্চলের বিষয়টি মাথায় রেখে তিন ক্যাটাগরির ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ছাড়া যেসব এলাকায় ইতোমধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতা বেশি হচ্ছে, সেসব এলাকার কেন্দ্রগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
এফপি/অ