প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক নীরব লীলাভূমি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীরা মনে করে থাকেন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রকৃতির সাথে সবচেয়ে বেশি সম্পর্ক এ বিশ্ববিদ্যালয়ের। এর রয়েছে অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্য—এ ক্যাম্পাসটি লালমাটির ছিমছাম টিলা দিয়ে বিস্তৃত। এর একাডেমিক ভবন থেকে শুরু করে আবাসিক হলগুলোও ‘লালমাটির’ টিলার উপর নির্মিত।
পত্র-পত্রিকা‚ ফিচার ও অন্যান্য গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে—‘লালমাটির ক্যাম্পাস’ বলে অভিহিত করা হয়। শিক্ষার্থীরা ভর্তির শুরুতে এ অনন্য নামটির প্রেমে পড়েন। দেখা যায়‚ স্যোশাল মিডিয়ায়ও শিক্ষার্থীরা সেই ‘লালমাটির ক্যাম্পাসে’র প্রচার করে থাকেন। জানা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিমছাম লালমাটির টিলাগুলো লালমাই পাহাড়েরই অংশ-বিশেষ।
বৈজ্ঞানিকভাবে একটি অঞ্চলের মাটি লাল হওয়ার পেছনে কারণ হলো—মাটিতে আয়রণ অক্সাইডের আধিক্য। ইতিহাস থেকে জানা যায়—এই লাল রঙের বৈশিষ্ট্যের কারণেই পাহাড়গুলোর নাম রাখা হয় ‘লালমাই পাহাড়’।
লালমাই নামক এ বিচ্ছিন্ন পর্বতশ্রেণীর অবস্থান বিশেষত কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলায়। প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনুমান করা হয়—প্রায় পঁচিশ লক্ষ বছর আগে ‘প্লাইস্টোসিন’ কালে এ পাহাড় গঠিত হয়েছিলো। যা বরেন্দ্রভূমি এবং মধুপুর ও ভাওয়াল গড়ের সমসাময়িক। এ পাহাড়ের আনুমানিক উচ্চতা ৪৬ মিটার এবং প্রায় ৮০০০ মিটার অঞ্চল জুড়ে এ পাহাড় বিস্তৃত। এর উত্তর অংশকে বলা হয় ‘ময়নামতি পাহাড়’ এবং দক্ষিণ অংশকে বলা হয় ‘লালমাই পাহাড়’।
এ বিষয়ে সেন্টা’ ফর পিপল এ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট-(সিপিই) এর ডিরেক্টর ও জলবায়ু-বিজ্ঞানী মুহম্মদ আবদুর রহমান জানান‚ ‘বাংলাদেশে মধুপুর গড়, ভাওয়ালের গড়, কুমিল্লার লালমাই পাহাড়সহ কুমিল্লা অঞ্চলের ছোট ছোট টিলাসমূহ, দিনাজপুর, বগুড়ার কিংয়দাংশ ২.৬ মিলিয়ন বছর পূর্বে প্লাইস্টোসিন পিরিয়ডে সৃষ্টি হয়। পাইস্টোসিন পিরিয়ডে সৃষ্টি হওয়া ভুমিসমূহ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত অনুসারে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুতপাতের কারণে সৃষ্টি হয়েছে। সেই সময়কালে সৃষ্টি হওয়া মাটিসমূহে ল্যাটেরাইট সমৃদ্ধ। এই ল্যাটেরাইট সমৃদ্ধ মাটিতে প্রচুর পরিমাণে ফেরিক অক্সাইড থাকে। এই ফেরিক অক্সা্ইডের আধিক্যের কারণে বাংলাদেশসহ ভারতের বেশকিছু স্থান যেগুলো প্লাইস্টোসিন পিরিয়ড়ে সৃষ্টি হয়েছে সেগুলোর মাটি লাল। কুমিল্লার লালমাই এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ছোট ছোট টিলামূহও সেই প্লাইস্টোসিন পিরিয়ডে সৃষ্টি হওয়া বলে এগুলার মাটিও লাল।’
এ পাহাড়ের নামকরণ নিয়ে নানান লোককথা বিদ্যমান। বলা হয়ে থাকে যে এক রাজার দুইটি কন্যা—‘লালমতি’ ও ‘ময়নামতি’র নামে দুই অংশের পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও বলা হয়ে থাকে—‘রাম-রাবণে’র যুদ্ধের সময় রামের ছোটভাই ‘লক্ষণ’ গুরুতর আহত হয়৷ বৈদ্য কতৃক লক্ষণকে ‘বৈশল্যকরণী’ পাতার রস লাগাতে বলা হয়। যথারীতি হনুমান বেরিয়ে পরে এ গাছের সন্ধানে। ‘হনুমান’ তখন এ গাছ চিনতে না পেরে পুরো পর্বতটাকেই তুলে নিয়ে আসে। চিকিৎসা সম্পন্ন হলে হনুমান ‘হিমালয়’ পর্বতকে যথাস্থানে রেখে আসার জন্য রওনা হয়। পথিমধ্যে এই পর্বতের কিছু অংশ কুমিল্লার ‘লমলম’ সাগরে পড়ে যায়। সে থেকে এ বিচ্ছিন্ন পর্বতশ্রেণীর নাম ‘লালমাই পাহাড়’।
লালমাটির সাথে কুমিল্লা অঞ্চলের এ অনন্য ঐতিহাসিক সম্পর্কের কারণে কুমিল্লার সেই বিশেষ বিচ্ছিন্ন পর্বতশ্রেণীর নাম লালমাই পাহাড়। একইসাথে লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে লালমাটির ছিমছাম পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় এ ক্যাম্পাস দীর্ঘদিন ধরে ‘লালমাটির ক্যাম্পাস’ হিসেবেই পরিচিত। এ ক্যাম্পাসের শিক্ষক-শিক্ষার্থী‚ কর্মকর্তা-কর্মচারী‚ অভিভাবক কিংবা ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী—সকলের কাছেই ‘লালমাটি’ একটি পরিচিত নাম। একই সাথে ‘লালমাটির ক্যাম্পাস’ সকলের নিকট এক স্মৃতিময় ও আবেগ-জড়িত একটি পরিচয়।
এফপি/এমআই