নোয়াখালীর হাতিয়ায় সভ্য সমাজে মধ্যযুগীয় বর্বরতার একটি নজির স্থাপিত হলো। শুধুমাত্র বিয়ে বাড়িতে মাইক বাজানোর অপরাধে বেত্রাঘাতের শিকার হলেন এক কনে ও তার মা-বাবাসহ পরিবারের সবাই। ক্ষমা চেয়েও মেলেনি পরিত্রাণ। দাবি করা হয়েছে মোটা অঙ্কের জরিমানা। জরিমানা দিতে না পারায় জামাতার উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন অটোরিকশাটিও আটকে রাখা হয়েছে। এ ঘটনায় পরিবারটি চরম অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।
গতকাল বুধবার দুপুরের দিকে হাতিয়া উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় একটি অনানুষ্ঠানিক বিচার সভায় এ অমানবিক রায় দেওয়া হয়।
জানা যায়, সেপ্টেম্বর মাসে বুড়িরচর এলাকার শাহজাহানের মেয়ের বিয়ে সম্পন্ন হয়। কিন্তু তখন অনুষ্ঠান না করে গতকাল বিয়ের অনুষ্ঠান করা হয়। এ উপলক্ষে আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে তারা সামান্য সময়ের জন্য মাইক ব্যবহার করেছিলেন। স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি ওই পরিবারের কাছে এর জবাব চাইতে গেলে সেখানে হট্টগোল সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে সেখানে উভয়পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। পরে স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েকজন এ বিচার বসান।
মেয়ের বাবা শাহজাহান জানান, আমি গরিব মানুষ। মেয়ের বিয়েতে শখ করে মাইক বাজিয়েছি। এজন্য আফসার, ছারোয়ার ও মালেক আমাদের পরিবারের সবাইকে মারধর করে। তারা আবার আমাদের জন্য সালিশ বাসায়। আলাউদ্দিন মাঝি, তছলিম, আনোয়ার মাঝি, সেন্টু ও রফিকসহ কয়েকজন সালিশদার আমাদের সবাইকে ১৫টি করে বেত মারার সিদ্ধান্ত নেয়। আমি এবং পরিবারের সবাই বারবার ক্ষমা চাওয়ার পরেও তারা কর্ণপাত করেনি। সবাইকে বেত মারার পর তারা ৩০ হাজার টাকা জরিমানাও করে। জরিমানার টাকা জোগাড় করতে না পারায় আফছার আমার মেয়ের জামাইয়ের অটোরিকশা আটকে রেখেছে। সমাজে অনেকের কাছে গিয়েছি, কোনো বিচার পাইনি।
সালিশে উপস্থিত থাকা একজন আলা উদ্দিন মাঝি বলেন, মাইক বাজানোর বিষয়ে আফসার জিজ্ঞেস করার কারণে হট্টগোল বাধে। ওখানে আফছারের ৫০ হাজার টাকা হারিয়ে গিয়েছে। যদিও আমরা তার সঠিক প্রমাণ পাইনি। তবুও আমাদের মধ্যে একজন সালিশদার এই টাকার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩০ হাজার টাকার রায় দিয়েছে। সালিশে মহিলাদেরকে বেত মারা হয়নি, পুরুষদেরকে মারা হয়েছে।
মহিলাদেরকে শাসন করার জন্য ঘরের মুরুব্বি হিসেবে শাহজাহানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে- তিনিই বেত মারবেন।
স্থানীয়রা বলছেন, এ ধরনের বিচার বা সালিশ সম্পূর্ণরূপে বেআইনি। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠিত আদালতই ফৌজদারি অপরাধের বিচার ও শাস্তি দিতে পারে। গ্রাম আদালতে বেত্রাঘাতের মতো শারীরিক শাস্তি দেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। এই ঘটনা শুধু ব্যক্তি স্বাধীনতার লঙ্ঘন নয়, এটি ফৌজদারি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। অপরাধীরা নিজেদেরকে আইনের ঊর্ধ্বে মনে করে এই ধরনের বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে। মাইক বাজানোর জন্য এভাবে একটি পরিবারকে নির্যাতন করা এবং আর্থিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।৷ এ বিষয়ে দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
এ বিষয়ে সাগরিয়া ফাঁড়ির পুলিশ পরিদর্শক এসআই ফরহাদ হোসেন বলেন, বিয়েতে মাইক বাজানোকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়েছে বলে শুনেছি। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছি। আমি উভয়পক্ষকে বলেছি আইনি ব্যবস্থা নিতে। তারা গ্রাম্য সালিশের আয়োজন করায় আমি আর সেখানে থাকিনি। এরপরে তারা আমাকে আর কিছু জানায়নি। এ বিষয়ে কেউ লিখিত অভিযোগ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এফপি/এমআই