চট্টগ্রাম বন্দরের বহুল আলোচিত বে-টার্মিনাল নিয়ে আবারও নতুন সময়সূচি ঘোষণা করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এবার লক্ষ্য— ২০২৬ সালের মাঝামাঝি কাজ শুরু করে ২০৩০ সালে টার্মিনালটিকে অপারেশনে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু বারবার সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়া ও প্রকল্পের ধীরগতি দেখে অনেকের মনে প্রশ্ন— ঘোষণার গতি যত, বাস্তবায়নের ততটা কি আছে?
সোমবার (৩ নভেম্বর) দুপুরে বন্দর অডিটোরিয়ামে 'জেনারেল মার্কেট এনগেজমেন্ট কনফারেন্স ফর দ্য বে টার্মিনাল মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট' শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মুনিরুজ্জামান জানান, ২০২৬ সালের মাঝামাঝিতে কাজ শুরু করে ২০৩০ সালে অপারেশন চালুর টার্গেট নেওয়া হয়েছে। তিনি দাবি করেন, বে-টার্মিনাল চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে বিনিয়োগের জোয়ার আসবে এবং বাংলাদেশকে আঞ্চলিক হাবে পরিণত করবে।
কিন্তু বন্দর সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করছেন, ২০১৬ সালে প্রকল্প ঘোষণার পর প্রায় এক দশক পার হলেও কাজের দৃশ্যমান অগ্রগতি সীমিত। জমি উন্নয়ন থেকে শুরু করে প্রাথমিক অবকাঠামো প্রস্তুতি— অনেক ক্ষেত্রেই কাজ এগোয়নি প্রত্যাশা অনুযায়ী। এর মধ্যেই আবার নতুন সময়সীমা ঘোষণা প্রশ্ন তুলছে, বাস্তবিক প্রস্তুতি কতটা?
বন্দর চেয়ারম্যান সভায় বলেন, আগামী বছরের মাঝামাঝি যদি প্রবেশপথে ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু করা যায়, তবে নির্ধারিত সময়েই টার্মিনাল চালু করা সম্ভব হবে। তবে স্বীকার করেছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপ পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) গাইডলাইনের আওতায় হওয়ায় প্রক্রিয়াগত বিলম্ব অনিবার্য। তার বক্তব্যেই ইঙ্গিত মিলেছে, কাগজপত্র ও অনুমোদনের ধীরগতি প্রকল্পকে বারবার পিছিয়ে দিচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, বে-টার্মিনাল চালু হলে ইউরোপ ও ফার ইস্টে সরাসরি জাহাজ পাঠানো সম্ভব হবে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানি খরচ ও সময় কমবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকলেও এখনও কোনো নির্দিষ্ট চুক্তি বা অর্থায়নের নিশ্চয়তা মেলেনি। বন্দর কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, বন্দরের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিদিন প্রায় এক মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হচ্ছে। অথচ বে-টার্মিনালের দেরিতে সেই ক্ষতি আরও বাড়ছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
প্রকল্পের আওতায় ব্রেকওয়াটার, নেভিগেশন চ্যানেল, রেল ও সড়ক সংযোগ, কনটেইনার ইয়ার্ড, জেটি এবং আধুনিক অপারেশনাল অবকাঠামো নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এসব কাজের জন্য যে আন্তর্জাতিক দরপত্র, অর্থায়ন ও অনুমোদনের ধাপ পেরোতে হবে— তা এখনও প্রাথমিক অবস্থায়। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, প্রশাসনিক জটিলতায় বে-টার্মিনালও হয়তো অন্য বড় প্রকল্পগুলোর মতো দীর্ঘসূত্রতার শিকার হবে।
প্রকল্পটির অবস্থান নগরীর উত্তর হালিশহর এলাকার উপকূলঘেঁষা অঞ্চলে। সেখানে পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সাগরের ধারে এই প্রকল্পের কারণে উপকূলের প্রতিবেশ ও স্থানীয় মৎস্যজীবীদের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, আন্তর্জাতিক মানের পরিবেশ ও সামাজিক মূল্যায়ন অনুসারে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে, তবে বিস্তারিত পরিকল্পনা এখনো প্রকাশ পায়নি।
বে-টার্মিনাল প্রকল্পের সামগ্রিক বাস্তবায়ন মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে ২০৩১ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু এই সময়সীমা কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। কারণ, ২০১৬ থেকে ২০২৫— এই দীর্ঘ সময়েও প্রকল্পের “প্রারম্ভিক প্রস্তুতি” ধাপ পুরোপুরি শেষ হয়নি।
বন্দরের ব্যবসায়ী রফিক উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর দেশের বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। বে-টার্মিনাল সেই প্রাণকেন্দ্রকে আরও শক্তিশালী করার স্বপ্ন। কিন্তু ঘোষণা আর বাস্তবতার ব্যবধান দিনে দিনে বাড়ছে। প্রকল্পের দেরি যেমন অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তেমনি জনগণের আস্থা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন একটাই বে-টার্মিনাল কি চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলবে, নাকি আরও একবার ঘোষণার ঝলকানিতে হারিয়ে যাবে বাস্তবের প্রমাণ?
এফপি/অ