বাংলাদেশ রেলওয়েতে আবারও বড় আকারের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। মাত্র ১ কোটি টাকার ডয়েটজ ডিজেল ইঞ্জিন স্পেয়ার পার্টস (Deutz Diesel Engine Spare Parts) কেনা হচ্ছে প্রায় ৮ কোটির বেশি টাকায়—এমন অভিযোগ উঠেছে রেলের প্রভাবশালী কর্মকর্তা ও ঠিকাদারি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি ই-জিপি (e-GP) সিস্টেমে প্রকাশিত চারটি টেন্ডার—আইডি নং 1093826, 1093885, 1093744 এবং 1092157—এর দরপত্র খোলা হয় ২৬ ও ২৭ মে ২০২৫ তারিখে। এতে মোট আটটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়, কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, নিয়ম অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে যোগসাজশে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ প্রদান করা হয়েছে।
দরপত্র প্রক্রিয়ায় একাধিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। টেন্ডারে Equivalent পণ্য উল্লেখ করা হয়নি, ISO সনদ ও Technical Specification Details চাওয়া হয়নি—যা দরপত্র মূল্যায়নের মৌলিক শর্ত। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এসব গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ছাড়া কীভাবে টেন্ডারের কারিগরি মূল্যায়ন সম্পন্ন হলো। সরবরাহকারীরা বলছেন, এসব শর্ত বাদ দিয়ে দরপত্র আহ্বান ও মূল্যায়ন করা হয়েছে পিপিআর ২০০৮-এর বিধি-২৯ স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করে, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট ঠিকাদারকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ অনুযায়ী, এই কাজটি পেয়েছে Next Generation Graphics Ltd (NGGL)—যা Fav Diesel Sales & Service গ্রুপের অংশ। এই গ্রুপের মালিকানা রয়েছে রেল মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সাবেক সভাপতি ফজলে করিম চৌধুরীর ছেলে ফারাজ করিমের হাতে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যে যন্ত্রাংশের বাজারমূল্য ১ থেকে দেড় কোটি টাকা, সেটি ৮ কোটির বেশি টাকায় কেনা হচ্ছে। অর্থাৎ প্রায় ৬ থেকে সাড়ে ৬ কোটি টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত বিল দেখিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাতের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
রেলের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, “ফ্যাসিবাদ সরকার পালিয়ে গেলেও রেলের প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ এখনো ফারাজ করিমের প্রভাবাধীন। কর্মকর্তাদের যোগসাজশে Fav Diesel Sales & Service প্রায় সব বড় টেন্ডারই নিজের কব্জায় নিচ্ছে।” তাদের মতে, টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটিতেও রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক চাপের কারণে প্রকৃত প্রতিযোগিতা নষ্ট হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে সিসিএস/পাহাড়তলী মোঃ বেলাল হোসেন সরকার ও সিইই/ পূর্ব মোঃ শফিকুর রহমান-এর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কেউ ফোন রিসিভ করেননি। শফিকুর রহমানের ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। জানা গেছে, বেলাল হোসেন সরকার যখন রাজশাহী রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলে কর্মরত ছিলেন, তখনও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে দুদক মামলা দায়ের করে, এবং সে সময় তাকে ওএসডি করা হয়। পরবর্তীতে তদবির করে তিনি আবার পাহাড়তলী সিসিএস পদে যোগদান করেন।
বাংলাদেশ রেলওয়েতে কর্মকর্তাদের একাংশ ও প্রভাবশালী ঠিকাদারি গোষ্ঠীর আঁতাত কোনো নতুন ঘটনা নয়। দীর্ঘদিন ধরে “কম দামে ক্রয়, বেশি দামে বিল”—এই প্রক্রিয়ায় সরকারি অর্থ লোপাট হয়ে আসছে। যেখানে ১ টাকার জিনিস ১০০ টাকায়, আর ১০০ টাকার জিনিস ১০০০ টাকায় ক্রয় করা হয়, সেখানে রেলের আর্থিক ক্ষতি অনিবার্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দুর্নীতির শিকল না কাটলে রেলওয়ে কেবল কাগজে-কলমে টিকে থাকবে, বাস্তবে নয়।
এফপি/অ