চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানি প্রায় ৯২ শতাংশ এই বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। বন্দরের কার্যক্রমে ধীরগতি এবং প্রশাসনিক জটিলতা এখন দেশের অর্থনীতির ওপর সরাসরি চাপ তৈরি করছে। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, কন্টেইনার খালাস ও জাহাজ ছাড়ার বিলম্বে তারা প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন।
চলতি সময়ে বন্দরের ইয়ার্ডে কন্টেইনারের সংখ্যা ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে খালাস প্রক্রিয়া ধীর হয়ে গেছে। আমদানিকারকরা অভিযোগ করছেন, পণ্য সময়মতো না আসায় গুদাম খরচ ও ডেমারেজ খরচ বেড়ে গেছে। এক আমদানিকারক বলেন, “একটা কন্টেইনার যদি একদিন দেরিতে ছাড়ে, তার প্রভাব পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পড়ে। এটি শুধু ক্ষতি নয়, শৃঙ্খলাও ভেঙে দেয়।”
রপ্তানিকাররাও সমস্যার মুখোমুখি। জাহাজ ছাড়ার সময়সূচি অনিশ্চিত হওয়ায় বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পণ্য সময়মতো পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। এতে জরিমানা এবং ভবিষ্যতের অর্ডার হারানোর ঝুঁকি বাড়ছে। বিজিএমইএ'র এক পরিচালক মন্তব্য করেছেন, “যখন পণ্য সময়মতো পৌঁছায় না, ক্রেতারা দেশের প্রতিযোগিতাশীলতার বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করে।”
বন্দর এলাকায় যানজট ও ট্রাকের দীর্ঘ লাইন সমস্যার একটি বড় কারণ। ট্রাকচালকরা জানান, আগে দিনে দুইবার ট্রিপ দেওয়া যেত, এখন একটাও সম্পূর্ণ করতে দেরি হচ্ছে। এতে জ্বালানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে এবং বাজারে সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে, যার প্রভাব পণ্যের মূল্যে পড়ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের ধীরগতি বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহে ঘাটতি, রপ্তানিতে ব্যাঘাত এবং মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির দিকে ধাক্কা দিতে পারে। অর্থনীতিবিদ ড. মাহমুদুল হক বলেন, “বন্দর বন্ধ বা ধীরগতি মানে দেশের অর্থনীতির রক্তপ্রবাহে বাধা। এটি প্রশাসনিক নয়, জাতীয় অর্থনৈতিক সমস্যা।”
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা কন্টেইনার খালাসের গতি বাড়াতে ও যানজট কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম চালু, শ্রমিক সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর ট্র্যাকিং ব্যবস্থার উন্নয়ন চলছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঘোষণার চেয়ে বাস্তব পরিবর্তনই জরুরি। চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের এক পরিচালক মন্তব্য করেছেন, “বন্দর আমাদের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড। এখানে ধীরগতি মানে রক্তপ্রবাহে বাধা। এই অচলাবস্থা যদি দীর্ঘ হয়, তবে তা কেবল বাণিজ্য নয়, পুরো অর্থনৈতিক কাঠামোকে দুর্বল করে দেবে।”
আজম নামের একজন ব্যবসায়ী বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর সচল থাকলে বাংলাদেশ সচল থাকে; কিন্তু বন্দর স্থবির হলে থেমে যায় দেশের অর্থনীতির চাকা।”
চট্টগ্রাম বন্দরের অচলাবস্থা শুধু ব্যবসায়ীদের ক্ষতির কারণ নয়, এটি দেশের শিল্প, বাজার ও রপ্তানির সামগ্রিক সক্ষমতাকে প্রভাবিত করছে। তাই প্রশাসনিক দক্ষতা, কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
এফপি/অ