Dhaka, Friday | 19 September 2025
         
English Edition
   
Epaper | Friday | 19 September 2025 | English
মানুষের অধিকার নিশ্চিত করাই প্রকৃত গণতন্ত্র : ড. মঈন খান
আমেরিকার সিকিউরিটি ডিভাইসের মাদারবোর্ড রপ্তানি করছে ওয়ালটন
নৌকা ভ্রমণে গিয়ে নিখোঁজ, দু’দিন পর নদীতে মিলল মরদেহ
আবাসন খাত রক্ষাই অর্থনীতির সুরক্ষা
শিরোনাম:

কক্সবাজার বনবিভাগ

বন্যহাতির বিচরণক্ষেত্র বনখেকোদের দখলে

প্রকাশ: শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ৬:১৯ পিএম  (ভিজিটর : ৫৮)

রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে কক্সবাজারে একের পর এক হাতির মৃত্যু হচ্ছে। তবে এনিয়ে মাঠ পর্যায়ে বেশ সরগরম দেখা গেলেও উপরি মহলের তেমন কোন পদক্ষেপ নজওে আসছে না। যার কারণে প্রতিনিয়ত হাতি মারা যাচ্ছে।

সম্প্রতি উখিয়া রেঞ্জ সহ বেশ কয়েকটি রেঞ্জে বন্যহাতি মারা গেছে গত ১৭ সেপ্টম্বর সকালে উখিয়া রেঞ্জের অধীনে সদর বিটের আওতায় দোছড়ি রফিকের ঘোনা এলাকায় মৃত অবস্থায় বন্য হাতি দেখতে পায় স্থানীয়রা। এদিকে উখিয়াতে হাতি যেদিন মারা যান সেদিন সিএফ মোল্লা রেজাউল করিম কক্সবাজার থাকলেও তিনি হাতিটি দেখতে যাননি। তিনি সদ্য পদোন্নতি প্রাপ্ত কর্মকর্তাদেও ফুল দিতে কক্সবাজারে অবস্থান করেছেন বলে জানা গেছে।

দক্ষিণ বন বিভাগ উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসলে হাতির মৃত্যুর আসল রহস্য জানা যাবে বলে জানা গেছে। এর আগে এই বছরের গত ১৩ মার্চ সকালে বন্যহাতির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বনবিভাগের কর্মকর্তারা মৃত হাতিটিকে দেখতে যান। এসময় কক্সবাজারে উপস্থিত ছিলেন প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসেন। তিনিও বন্যহাতির মৃত্যু ঘটনা কেন হলো তা সরেজমিনে দেখতে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এ পর্যন্ত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩টি হাতি কক্সবাজারে দক্ষিণ বনবিভাগে মারা গেছে যা রেকর্ড় সংখ্যক বলা চলে। হাতির গায়ে আঘাতের চিহ্ন থাকলেও, এই হাতিটিকে মেরে ফেলা হয়েছে- এমন দাবি মানতে নারাজ কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম।

স্থানীয়দের বরাত দিয়ে বনবিভাগ জানায়, উখিয়া রেঞ্জের সংরক্ষিত বনের জুমছড়ি এলাকায় একটি বন্যহাতি মৃত অবস্থায় দেখতে পায় ইআরটি সদস্যরা। পরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ও ভেটেনারি সার্জনকে খবর দিলে তারা প্রাথমিক আলামত সংগ্রহ করে।

ভেটেনারি সার্জনের এক কর্মকর্তা জানান, হাতিটির শরিরের ভিতর থেকে তিনটি গুলির (সীসা) বের করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা  হচ্ছে এই গুলির আঘাতে বন্যহাতিটি মারা যেতে পারে।

কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম জানান, উখিয়া রেঞ্জের সদর বিটের জুমছড়ি এলাকায় মৃত হাতিটি সরেজিমনে দেখেছি। হাতিটি শারীরিকভাবে অসুস্থতার কারণে মারা যায় বলে ধারণা করা হচ্ছে। হাতির বয়স আনুমানিক ৩৫ বছর। প্রায় দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত রক্তের দাগ রয়েছে। সুরতহাল করা হয়েছে, ময়না তদন্ত রিপোর্ট পেলে বিস্তারিত জানতে পারবো।

এদিকে বনবিভাগের অবহেলা ও বনকে পর্যটকখাতে উন্নয়ন করার কারণে হাতি চলাচলের পথ, খাদ্য স্থান কমার ফলে দিন দিন হাতি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে দুর্বল অবস্থায় বনে মরে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। ঠিক তেমনি কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের টেকনাফ রেঞ্জে প্রতিনিয়ত হাতি মারা যাচ্ছে। এর আগে ২টি হাতি মারা গেছে। গত ৫ জানুয়ারি, বাচ্চা প্রসবের সময় টেকনাফের হোয়াইক্যং বনবিটে একটি মা হাতির মৃত্যু হয় এবং আরেকটি গত ১৮ জানুয়ারি হ্নীলা বিটের পাহাড়ি ছড়া মৃত হাতির সন্ধান পাওয়া যায় পরে তা পোস্টমর্টেম করে মাটিতে পুতে ফেলা হয় বলে জানা যায়। এছাড়া গত বছরের ১৬ আগস্ট উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নে নোয়াখালীপাড়ায় বিদ্যুতায়িত হয়ে একটি বন্যহাতির মৃত্যু হয়। এভাবে হাতি শূন্য হতে পারে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।

প্রকৃতি বিধ্বংসী কর্মকান্ডে দেশে হাতির আবাস্থল হুমকির মুখে পড়েছে। কিছুদিন আগে উখিয়াতে খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসে হাতির একটি পাল। উখিয়া রেঞ্জ সেই হাতিগুলোকে নিরাপদে পাশ্বর্বতী পাহাড়ে তুলে দিয়েছে। গত এক দশকে বিভিন্ন জেলার বনাঞ্চলে হাতি বিচরণ আয়তন সংকুচিত হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে প্রাকৃতিক খাবার সংকট। যুগযুগ ধরে একের পর এক বন্যপশু চলাচলের পথে সড়ক, রেলপথ ও বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে।

প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে পরিবেশবাদীদের কঠোর আপত্তি ছিল উপেক্ষিত। হাতির বিচরণ আছে এমন এলাকাগুলোতে প্রাকৃতিক অনেক ঝিরি-ঝর্ণা শুকিয়ে গেছে। এতে বাধ্য হয়ে খাবার ও পানির সন্ধানে লোকালয়ে ঢুকছে বন্যহাতী। দেশে বাঘ রক্ষায় বন অধিদফতরে বহুমুখি কার্যক্রম থাকলেও প্রোবোসিডিয়া বর্গের একমাত্র জীবিত বংশধর ‘হাতি’ রক্ষায় ঢিলেঢালা ভাব রয়েছে। এখন বছরে একদিন ‘বিশ্ব হাতি দিবসে’ সভা-সেমিনারে সীমিত হয়ে পড়েছে হাতি রক্ষার হাকডাক। বনভূমি ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় বন অধিদফতরের অক্ষমতা এবং পর নির্ভর জরিপে কাগজে কলমে দেশে বেঁচে থাকা ২৬৮টি হাতির সংখ্যা বিশ্বাস না করলেও করতে হবে।

২০১৭ সালে বন বিভাগ এবং আইইউসিএনের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে আবাসিক হাতির বিচরণ বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। দেশের বনাঞ্চলে আবাসিক বন্যহাতি আছে ২৬৮টি। এ ছাড়া দেশের সীমান্তবর্তী পাঁচটি বনাঞ্চলে ৯৩ থেকে ১০৭টি পরিযায়ী হাতি বিচরণ করে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে ৯টি বিভাগীয় বন অফিসের আওতায় হাতি চলাচলের ১১টি রূট চিহ্নিত করা হয়েছিল, যার দৈর্ঘ্য ১৫১৮ কিলোমিটার। গত ছয় বছরে বন্ধ হয়ে গেছে হাতি চলাচলের তিনটি করিডোর। কক্সবাজার উখিয়া ও টেকনাফ পাহাড়ি বনাঞ্চলে কয়েকটি হাতি চলাচলের করিডোর ছিল। তবে ২০১৭ সালে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে উজাড় হয়েছে ৬ হাজার একর বনভূমি। এতে উখিয়া ও টেকনাফে হাতি চলাচলের অধিকাংশ করিডোর বন্ধ হয়েছে। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প হাতির জন্য বড় বিপদ হিসেবে দেখছেন পরিবেশবিদরা। রেলপথটি বন্যহাতির অন্যতম তিন বিচরণক্ষেত্র চুনতি, ফাসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর। এতে হাতি চলাচলের ২১টি পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। কক্সবাজারে গত তিন বছরে প্রাণ গেছে ৮টি বন্যহাতির। রোহিঙ্গা বসতিতে হাতির আক্রমণে কয়েকজন রোহিঙ্গা মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। আইইউসিএন ও বন বিভাগের তথ্য মতে, গত ১৮ বছরে দেশে মানুষের হাতে হত্যার শিকার হয়েছে ৯০টি বন্যহাতি। করোনাকালে ১২টি হাতি হত্যা করা হয়েছে। আর ২০১৯ থেকে চলতি ২০২১ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত হাতির আক্রমণে ৪০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।  

অনুসন্ধান বলছে, বন অধিদফতরের কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণে বিভাগীয় দফতরগুলো অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। তবে একদিকে উচ্ছেদ অন্যদিকে ফের দখল হওয়ায় সরকারি অর্থ ও কর্মঘন্টা অপচয় হচ্ছে। কক্সবাজারে পাহাড় ন্যাড়া করে লেবু চাষের হিড়িক পড়েছে। কৌশলে হাতি চলাচলের পথগুলোতে কাটাযুক্ত লেবুবাগান গড়ে তুলে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি বন্ধ করতে মরিয়া বন দখলকারীরা। এতে হাতি চলাচলের দীর্ঘদিনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। সম্প্রতি কক্সবাজার রামু উপজেলায় কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের রোয়ারঘোনা এলাকায় সাইফুল বনভূমি দখল করে লেবু বাগান গড়ে তুলেছে। অতীতে সেখানে হাতি দেখা যেত বলে স্থানীয়দের অভিমত। এ ছাড়া কক্সবাজার রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জে নজির আলমের মতো আরও অনেকে বনভূমি দখল করে লেবু বাগান গড়ে তুলেছেন। ফলে বিচরণ আয়তন সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি চলাচলের পথগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লোকালয়ে প্রবেশ করছে হাতি।

পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা সভাপতি এইচ এম এরশাদ জানান,দেশে বন্যপ্রাণী রক্ষায় বন অধিদফতরে একটি সার্কেল রয়েছে। আছে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। তবে তাদের জনবলসহ বহুমুখি সংকট করেছে। বন অধিদফতরে মাঠ পর্যায়ে কর্মরতদের বন্যপ্রাণী বিষয়ক প্রশিক্ষণ নেই। প্রশিক্ষণ না দিয়ে তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশার সুযোগ নেই। দেশে হাতির বিচরণ আয়তন কমেছে। এখন দেশে কোণ কোণ বনাঞ্চলে হাতি রয়েছে, হাতির খদ্যাভাসসহ আরও বেশ কিছু বিষয়ে গবেষণা প্রয়োজন। বাঘ রক্ষায় বন অধিদফতর যতোটা গুরুত্ব দেয়, হাতি রক্ষার ক্ষেত্রে তেমন নয়। দেশে হাতি সংখ্যা কতো তা কিভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। হাতি নিয়ে গবেষণা করতে বন অদিদফতরে কি জনবল রয়েছে। গবেষণা কাজে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা কি আছে।

ইয়ুর্থ ইনভাইরেন্টমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) এর প্রধান নির্বাহী এম ইব্রাহিম খলিল মামুন জানান, হাতি কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, পাহাড়ী এলাকায় বন উজাড় করে লেবু বাগান ও প্রভাবশালীরা বন দখল করে চাষাবাদ করছে। বনভূমি ও পাহাড় জবরদখলের কারণে হাতিদের গতিপথ পাল্টে গেছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সাংগঠনিক সম্পাদক এইচএম নজরুল ইসলাম জানান, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে হাতি চলাচলের পথ সুরক্ষিত রেখে উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। তবে এই দেশে তা উপেক্ষিত। হাতি ও মানুষের সহাবস্থানের বিষয়টি মাথায় রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো গ্রহণ করা প্রয়োজন। বন দখল করে, কোথাও পাহাড় ন্যাড়া করে লেবু বাগান গড়ে তুলেছে প্রভাবশালীরা। এতে হাতি চলাচলের অনেক পথ বন্ধ হয়েছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকতে লোকালয়ে হাতির আক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি মায়ানমার জঙ্গলের দিকে হাতি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কক্সবাজার দক্ষিণ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ নুরুল ইসলাম বলেন, গত দুই অর্থবছরে উখিয়া ও টেকনাফে প্রায় ৭৪০ একর বনভূমিতে হাতির নিরাপদ আবাসস্থল, খাদ্য ও করিডোর উন্নয়নের কাজ হয়েছে। রামু, উখিয়া ও টেকনাফে বেশ কিছু হাতি চলাচলের করিডোর চিহ্নিত করা হয়েছে।

এফপি/রাজ
সর্বশেষ সংবাদ  
সর্বাধিক পঠিত  
YOU MAY ALSO LIKE  
Editor & Publisher: S. M. Mesbah Uddin
Editorial, News and Commercial Offices: Akram Tower, 15/5, Bijoynagar (9th Floor), Ramna, Dhaka-1000
Call: 01713-180024, 01675-383357 & 01840-000044
E-mail: news@thefinancialpostbd.com, ad@thefinancialpostbd.com, hr@thefinancialpostbd.com
🔝