ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনালে সূচনা বক্তব্য ও প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে।
রোববার সকাল ১১টা ৩০ মিনিটে ঢাকা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর অনুমতিতে এই বিচারপ্রক্রিয়া সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে, যা দেশের বিচার ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত।
এই মামলায় প্রধান আসামি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ১৪ জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, দমন-পীড়ন এবং যুদ্ধাপরাধসদৃশ অপরাধের পাঁচটি পৃথক অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার অন্যতম আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আদালতে দোষ স্বীকার করে ‘অ্যাপ্রুভার’ বা রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিচ্ছেন।
পাঁচটি অভিযোগের সারসংক্ষেপ:
উসকানিমূলক বক্তব্য
শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্রদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে আখ্যায়িত করেন। এরপর তার নেতৃত্বে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ ও প্ররোচনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে প্রায় ১,৫০০ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে এবং ২৫,০০০ জনকে আহত করে।
মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ
আদালতে উপস্থাপিত ফোনালাপের অডিওর ভিত্তিতে বলা হয়, শেখ হাসিনা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশপ্রধানের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করতে ড্রোন, হেলিকপ্টার ও মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন। ট্রাইব্যুনাল এটিকে ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি’র আওতায় বিবেচনা করছে।
রংপুরে ছাত্র হত্যা
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ডের জন্য শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান ও আল-মামুনকে দায়ী করা হয়েছে।
চানখাঁরপুলের ঘটনা
রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয় নিরীহ আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যার অভিযোগও এই মামলায় অন্তর্ভুক্ত।
আশুলিয়ায় আগুনে পুড়িয়ে হত্যা
আশুলিয়ায় ছয়জন নিরস্ত্র ব্যক্তিকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনায় আসামিদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ দায় আরোপ করা হয়েছে।
মামলার অগ্রগতি
এটি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে ওঠা চতুর্থ মামলা। এর আগে চলতি বছরের ২ জুলাই আদালত অবমাননার একটি মামলায় তাঁকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বর্তমান মামলাটি তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দেওয়া শাস্তিমূলক বিচারপ্রক্রিয়া।
আদালত সূত্রে জানা যায়, এই মামলায় প্রথম পর্যায়ের সাক্ষীরা প্রত্যক্ষদর্শী এবং আন্দোলনের সময় আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি। সাক্ষ্যগ্রহণের সময় নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু তথ্য গোপন রাখা হয়েছে।
আদালতের অবস্থান
বিচারকরা জানিয়েছেন, মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণ ও দলিল উপস্থাপন ৪ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করায় বিচার কার্যক্রম ‘ইন অ্যাবসেনশিয়া’ পরিচালিত হচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল এই বিচারকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আইনি ব্যবস্থার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হিসেবে দেখছে। তবে এর স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়েও কিছু প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে শিক্ষার্থী ও তরুণদের নেতৃত্বে দেশজুড়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলন দমনে সহিংস রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের অভিযোগ ওঠে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, ওই সময় প্রায় ১,৪০০ জনের মৃত্যু হয় এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হন।
এই মামলার রায় বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা, রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চিত্রে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
এফপি/রাজ