মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী মুরইছড়া চা বাগানের বাসিন্দা অনিল সাওতাল ও গৃহিনী সনচড়িয়া সাওতালের একমাত্র সন্তান গোপাল সাওতাল। শিশুটির বয়স সাড়ে তিন বছর জন্ম থেকে সে শারীরিক প্রতিবন্ধী।
সবার সহযোগিতা নিয়ে সমাজের অন্য শিশুদের মতো সে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে চায়। শিশুটি স্বাভাবিকভাবে দাঁড়াতে বা বসতে পারে না। বসিয়ে রাখলে সে ভাঁজ হয়ে পড়ে থাকে। তাই খাওয়ানো ও অন্যান্য পরিচর্যার জন্য মা সনচড়িয়া সাওতাল প্রায় ছয় মাস আগে ঘরের মেঝেতে ছোট একটা গোলাকার গর্ত করেছেন। প্রায় আড়াই ফুট গভীর সেই গর্তে শিশু সন্তান গোপালকে ঢুকিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। শিশুটির মাথা ও হাত দুটি যাতে বাইরে থাকে এমন করে গর্তটি করা হয়েছে।
ক্ষুধার সময় প্রচণ্ড কান্নাকাটি করলে মা শিশুটিকে গর্তে ঢুকিয়ে খাওয়ান। দিনের বেশিরভাগ সময় কান্না করলে তাকে ওই গর্তের ভেতরে রেখে বিভিন্ন বিনোদন দেখিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করেন মা। আর এ কাজে সহযোগিতা করেন গোপালের দাদী কল্পনা সাওতাল। মা সনচড়িয়া সাওতাল ঘরের কাজ সামলানোর পাশাপাশি সারাক্ষণ ছেলেকে দেখে রাখেন। বাবা অনিল সাওতাল মুরইছড়া চা বাগানে ১৭০ টাকা মজুরীতে কাজ করেন। অভাব-অনটনের সংসারে সন্তানের চিকিৎসা করানো তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। জীর্ণশীর্ণ একটি ঘরে তাদের কোনোমতে বসবাস।
অভাব-অনটনের সংসারে জন্ম নিলেও গোপাল সাওতালকে নিয়ে মা-বাবার অনেক স্বপ্ন। স্বপ্ন থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্যতার কাছে সেই স্বপ্ন থমকে যাচ্ছে তাদের। তাদের স্বপ্ন, সবার সহযোগিতায় তাদের সন্তান যেন সুস্থ হয়ে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করবে। সম্প্রতি কুলাউড়ার অগ্রণী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিক সঞ্জয় দেবনাথের ব্যক্তিগত ফেসবুকে দেখে রবিবার (১৫ জুন) বিকেলে মুরইছড়া চা বাগানের স্কুল টিলা এলাকায় গেলে ঘরের ভেতর এমন একটা হৃদয় নিংড়ানো দৃশ্য চোখে পড়ে। রোদ, ঝড় কিংবা বৃষ্টি মাড়িয়ে একটি জীর্ণশীর্ণ ঘরের ভেতর তাদের বসবাস। ঘরের বাহিরে একমাত্র সম্বল কয়েকটি গবাদিপশু রয়েছে। কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়ে প্রতিবন্ধী শিশু গোপালকে নিয়ে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন তার পিতা অনিল সাওতাল, মা সনচড়িয়া সাওতাল ও দাদি কল্পনা সাওতাল।
আলাপকালে শিশু সন্তান গোপাল সাওতালের মা সনচড়িয়া সাওতাল জানান, জন্ম থেকেই তার সন্তান শারীরিক, বুদ্ধি, বাক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। শিশুটির চিকিৎসার জন্য সম্প্রতি সিলেটের খাদিমনগরের একটি সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানকার চিকিৎসক বলেছেন শিশুটিকে নিয়মিত ফিজিওথেরাপি দিতে হবে। এটাই তার উন্নতির একমাত্র পথ। কিন্তু এ ধরনের থেরাপি নিয়মিত নেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই তাদের।
তিনি বলেন, ছেলেটির কান্না আর কষ্ট আমি কি করে সহ্য করি। তাই বাচ্চাকে শান্ত রাখার জন্য আড়াই ফুট গভীর এই গর্তটি করেছি। সেখানে ঢুকালে ছেলেটি একটু দাঁড়াতে পারে। আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। একমাত্র স্বামী বাগানে শ্রমিকের কাজ করে আমাদের জোড়াতালির সংসার চালাচ্ছেন। সামর্থ্য থাকলে যন্ত্রপাতি কিনে আনতাম শিশুর জন্য। শুনেছি এইরকম প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের জন্য নাকি ডিজাইন করা অনেক যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়।
সরকার ও সমাজের বিত্তমানদের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি, সবার সহযোগিতায় আমার শিশু ছেলেকে উন্নত চিকিৎসা করাতে চাই। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন যেন সে সমাজের অন্যান্য বাচ্চাদের মতো সুস্থভাবে বেঁচে থাকে।
কুলাউড়ার অগ্রণী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিক সঞ্জয় দেবনাথ বলেন, অনিল ও সনচড়িয়া সাওতালেল একমাত্র শিশু সন্তানটি যেন একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, নিজের মতো করে হাঁটতে পারে এটাই একমাত্র চাওয়া তার বাবা-মায়ের এবং আমাদের সমাজের সবার। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর পরিবারে প্রতিবন্ধী ছোট্ট শিশুটি বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকবে সেটা কারো কাম্য হতে পারে না। তার চিকিৎসার জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায় ছাড়াও সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।
উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা প্রানেশ চন্দ্র বর্মা বলেন, আমি বিষয়টি জেনেছি, শিশুর প্রতিবন্ধী ভাতার কাজ প্রক্রিয়াধীন এবং এ মাসেই ভাতার টাকা পাবে। রোগী কল্যাণ সমিতি থেকে চিকিৎসা সংক্রান্ত সাহায্য করা হবে। প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র, মৌলভীবাজার থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও উপকরণ সরবরাহ করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন বলেন, বিষয়টি খুবই মানবিক। প্রতিবন্ধী শিশু গোপাল সাওতালের খোঁজ নিয়ে সমাজসেবা অফিসারের সঙ্গে কথা বলে সরকারের পক্ষ থেকে ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তাও করা হবে। সে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবসময় খোঁজখবর রাখা হবে।
এফপি/রাজ