যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যবিষয়ক আলোচনায় শুল্ক হ্রাসের চুক্তি হওয়ার পর বিশ্ববাজারে বড় ধরনের উত্থান দেখা গেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক “সম্পূর্ণ পুনর্গঠন" হয়েছে, যা দীর্ঘদিনের বাণিজ্যযুদ্ধ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের অংশ।
সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আলোচনার পর পারস্পরিকভাবে আরোপিত উচ্চ শুল্ক উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ১৪৫ শতাংশ থেকে শুল্ক কমিয়ে ৩০ শতাংশে আনছে। চীনও তাদের পাল্টা শুল্ক ১২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনছে। খবর বিবিসির।
তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়েছেন, এই শুল্কগুলো স্থায়ীভাবে বাতিল না হয়ে সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে এবং আগামী তিন মাসে অগ্রগতি না হলে তা আবারও বাড়তে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, “চীনকে আঘাত করার ইচ্ছা আমাদের নেই, কিন্তু তারা ইতোমধ্যে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ছে—তারা আমাদের সঙ্গে চুক্তি করতে পেরে সন্তুষ্ট।”
ট্রাম্প আরও জানিয়েছেন, তিনি সম্ভবত সপ্তাহের শেষ দিকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে আবারও কথা বলবেন।
এদিকে চুক্তির ঘোষণার পর বিনিয়োগকারীরা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক বেড়েছে ৩.২ শতাংশ। এছাড়া ডাও জোন্স বেড়েছে ২.৮ শতাংশ এবং নাসডাক সূচক বেড়েছে ৪.৩ শতাংশ।
এই উত্থানের ফলে সূচকগুলো বছরের শুরুতে যেখানে ছিল, সেখানে ফিরে গেছে। ২ এপ্রিল “লিবারেশন ডে” ঘোষণার পর বাজারে যে ধস নেমেছিল, তা এই চুক্তির মাধ্যমে পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ওই সময় একটি সর্বজনীন আমদানি শুল্ক আরোপ করে এবং ৬০টি প্রধান বাণিজ্য অংশীদার—যাদের “সবচেয়ে খারাপ অপরাধী” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল—তাদের ওপর অতিরিক্ত হার আরোপ করা হয়। চীন ছিল এই তালিকায় অন্যতম।
যুক্তরাষ্ট্র “লিবারেশন ডে”-তে ঘোষিত চীনা পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ ‘রেসিপ্রোকাল’ শুল্ক বহাল রাখলেও, বাড়তি শুল্ক স্থগিত থাকবে ৯০ দিন।
অবৈধ ফেন্টানিল পাচার বন্ধে চীনের ওপর আরোপিত অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক বহাল রাখা হয়েছে। চীন তার প্রতিশোধমূলক শুল্কও ১০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে এবং অতিরিক্ত অশুল্ক বাধা অপসারণে সম্মত হয়েছে।
যেসব খাতে আগে থেকেই উচ্চ শুল্ক ছিল (যেমন স্টিল, গাড়ি) সেগুলো বহাল থাকছে। তবে অতিরিক্ত প্রতিশোধমূলক শুল্ক বাতিল করা হয়েছে।
এদিকে শুল্ক যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্যবাহী জাহাজ আগমনের হার হ্রাস পেয়েছে, চীনে উৎপাদন কমেছে এবং অনেক শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই চুক্তিকে “ভিন্নতা নিরসনের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ” বলে উল্লেখ করেছে।
চীনের শেনজেনে অবস্থিত একটি কারখানার মালিক তাত কেই বলেন, “চুক্তিটি স্বস্তিদায়ক, কিন্তু ট্রাম্প এখনও সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় থাকবেন। আমি নিশ্চিত নই এটা চূড়ান্ত কিনা।”
এটলাস ওয়েজের গ্রেটার চায়না প্রধান এলেন লি মনে করেন, “অনেক চীনা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এই বিরতিকে সাময়িকভাবেই দেখবে এবং পরবর্তী শুল্ক যুদ্ধের আগে নিজেদের রক্ষা করার কৌশল নেবে।”
ওয়াল স্ট্রিটে টার্গেট, হোম ডিপো, নাইকির শেয়ার বেড়েছে। এনভিডিয়া, অ্যামাজন, অ্যাপল, মেটাসহ প্রযুক্তি খাতেও বড় উত্থান হয়েছে। ইউরোপীয় বাজার ও হংকংয়ের হ্যাংসেং সূচক বেড়েছে ৩ শতাংশ। এছাড়া শিপিং কোম্পানি মার্কস ১২ শতাংশ ও হাপাগ-লয়েড ১৪ শতাংশ বেড়েছে।
মার্কস বিবৃতিতে বলেছে, “এই চুক্তি সঠিক পথে একটি পদক্ষেপ। আমরা একটি স্থায়ী চুক্তির প্রত্যাশা করছি যাতে আমাদের গ্রাহকরা দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস পায়।”
ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশন বলেছে, “এই সাময়িক বিরতি খুচরা বিক্রেতাদের জন্য স্বস্তিদায়ক এবং আসন্ন ছুটির মৌসুমে পণ্যের অর্ডার নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।”
আন্তর্জাতিক চেম্বার অফ কমার্স বলেছে, এই চুক্তি “কঠোর বিচ্ছিন্নতা” এড়ানোর ইঙ্গিত দেয়। ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল অ্যান্ড্রু উইলসন বলেন, “এই চুক্তি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও বৈশ্বিক চাহিদার ওপর যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, তা কাটিয়ে ওঠার একটি ভিত্তি তৈরি করতে পারে।”
এদিকে, সুরক্ষামূলক সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত স্বর্ণের দাম ৩.১ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি আউন্সে তিন হাজার ২২৩.৫৭ ডলার।
এফপি/এমআই