মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গানবোট ও হেলিকপ্টারে বরিশালে প্রবেশ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারা বর্তমান শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিপরীত দিকের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়াপদা কলোনি দখল করে। সেখানে একাধিক ভবনে স্থাপন করে ক্যাম্প ও টর্চার সেল। কীর্তনখোলা নদীর তীরবর্তী এই ক্যাম্প থেকেই ঝালকাঠি, পটুয়াখালী ও ভোলায় অপারেশন চালাত পাকিস্তানি বাহিনী। ক্যাম্প-সংলগ্ন কীর্তনখোলার শাখা সাগরদী খালের তীরে কয়েকটি বাংকার তৈরি করে বসানো হয় পাহারা। টর্চার সেলে বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ নারী-পুরুষকে ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা করা হতো। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, গুলি করে মরদেহ ফেলা হতো খালে। খাল ধরে জোয়ারের সময় মরদেহ গিয়ে পড়ত কীর্তনখোলা নদীতে।
স্বাধীনতার পর এলাকাটি বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সাগরদী খালের তীর থেকে ওয়াপদা কলোনির টর্চার সেলের কক্ষগুলোসহ দেড় একর জায়গাজুড়ে ‘বধ্যভূমি ও টর্চার সেল সংরক্ষণ প্রকল্প’ হাতে নেওয়া হয়। প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বরিশাল সিটি করপোরেশন। বধ্যভূমি কমপ্লেক্সের দুটি টর্চার সেলের ভেতরে সাউন্ড সিস্টেমে বাজত নির্যাতনের আবহ সৃষ্টিকারী নারী-পুরুষের আর্তনাদ। পুরো কমপ্লেক্সে মৃদু শব্দে বাজত মুক্তিযুদ্ধের গান। প্রতিটি জাতীয় দিবসে প্রশাসন ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষে বধ্যভূমিতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হতো। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিকেলে সেখানে হামলা ও ভাঙচুর চালায় একদল লোক। লুট করা হয় সাউন্ড সিস্টেম, বেশ কিছু লাইটসহ বিভিন্ন জিনিস। এর পর থেকে পরিত্যক্ত মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল স্মৃতিবহ জায়গাটি।
বধ্যভূমি কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, বাংকার ও টর্চার সেলের ভেতর নির্যাতনের শিকার নারী-পুরুষের আর্তনাদের সাউন্ড সিস্টেম নেই। দর্শনার্থীরা আগের মতো সহজে কমপ্লেক্সে প্রবেশ করতে পারেন না। মূল সড়ক থেকে কমপ্লেক্সে প্রবেশে খালপাড়ে সিটি করপোরেশন ওয়াকওয়ে নির্মাণ করেছে। তবে পুরো কাজ শেষ হয়নি। তাই লাফিয়ে কয়েক ফুট নিচুতে নেমে কমপ্লেক্সে প্রবেশ করতে হয়।
বধ্যভূমি কমপ্লেক্সের নিরাপত্তাকর্মী জাকির হোসেন জানান, ৫ আগস্ট ভাঙচুর চালানোর পর সেপ্টেম্বর মাসের এক গভীর রাতে একদল লোক এসে দুই নিরাপত্তীকর্মীকে মারধর করে। কমপ্লেক্সের ভেতরে ঢুকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করে রং দিয়ে বিভিন্ন শব্দ লেখে তারা। জেলা প্রশাসনকে জানানোর পর সেগুলো ঘষে তুলে ফেলা হয়েছে।
বধ্যভূমি ও নির্যাতন সেল সংরক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশনকে সহযোগিতা করেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, বরিশাল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এবং বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদ। ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত দিবসে এর উদ্বোধন করা হয়। এখানে রয়েছে নির্যাতনের স্মৃতিবহ বাংকার, বধ্যভূমি, সেতু ও মরদেহ ভাসিয়ে দেওয়া সাগরদী খাল। প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকত।
বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি শুভংকর চক্রবর্তী বলেন, ৫ আগস্ট বধ্যভূমি কমপ্লেক্সের অনেক নিদর্শন ভাঙচুর করা হয়েছে। সেগুলো আর সংস্কার হয়নি। বধ্যভূমির ভেতরে অপরিচ্ছন্ন। কয়েকটি লাইট ভালো আছে। সন্ধ্যা হলে সেগুলোই জ্বালানো হয়। দেয়ালে আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের স্মারক ম্যুরালগুলোর চারপাশে শ্যাওলা জমেছে। বধ্যভূমিটি সংস্কারে কোনো উদ্যোগ নেই।
ওয়াপদা কলোনিতে নির্যাতনের শিকার বীর মুক্তিযোদ্ধা এএমজি কবীর ভুলু। তিনি টানা ১৯ দিন বন্দি ছিলেন। সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও ভয়াবহ নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে তিনি কেঁদে ওঠেন। কবীর ভুলু বলেন, ওয়াপদা কলোনির একাধিক টর্চার সেলে বাঙালি নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে সীমাহীন নির্যাতন করা হতো। এরপর সাগরদী খালের সেতুতে নিয়ে গুলি করে হত্যা করত পাক বাহিনী। জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আলম ফরিদ বলেন, বধ্যভূমিটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে বিশেষ এক ভূমিকা পালন করবে। এটি দ্রুত সংস্কার করা উচিত।
সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল বারী জানান, বধ্যভূমি কমপ্লেক্স সংস্কার করার বিষয় তাদের বিবেচনায় রয়েছে।
এফপি/এমআই