সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় কবে ঘোষণা করা হবে, তা আজ জানানোর কথা রয়েছে।
গত ২৩ অক্টোবর মামলার বিচারকাজ শেষ হলে চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ রেখে বলেছিলেন, আজ (বৃহস্পতিবার) রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করা হবে। তবে সেটা (রায় ঘোষণা) হবে খুব তাড়াতাড়ি। ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
গত ৮ অক্টোবর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলে ১২ অক্টোবর থেকে শুরু হয় যুক্তিতর্ক। টানা পাঁচ দিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন চিফ প্রোসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। গত ১৬ অক্টোবর প্রোসিকিউশনের যুক্তিতর্ক শেষ হলে ২০ অক্টোবর থেকে আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শুরু হয়। রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী টানা তিন দিন শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।
সেই ধারাবাহিকতায় গত ২৩ অক্টোবর পাল্টা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে দুই পক্ষই। তার আগে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ট্রাইব্যুনালে সমাপনী বক্তব্য দেন।
সেদিন ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিচার যত কঠিনই হোক, যত বাধাই আসুক, সমস্ত বাধার প্রাচীর ভেঙে যদি বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হয়, তাহলে আমরা জাতি হিসেবে আগামী দিনে এগোতে পারব না।’
চূড়ান্ত যুক্তিতর্কে চিফ প্রোসিকিউটর শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করেন ট্রাইব্যুনালের কাছে।
আর রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন দাবি করেন, তাঁর মক্কেলরা নির্দোষ, তাঁরা খালাস পাবেন।
রায়ের তারিখ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এরপর গত ৯ অক্টোবর সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে সুপ্রিম কোর্ট, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবন এলাকায় বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়া রায়ের তারিখ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনাল ও আশপাশের এলাকায় নেওয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়।
এরপর চলতি বছরের ২৫ মে থেকে ৮ অক্টোবরের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে যেসব মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে, তার মধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলা আটটি। এর মধ্যে পাঁচটি মামলায় অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেছেন ট্রাইব্যুনাল। বিচারাধীন পাঁচটি মামলার মধ্যে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে এই মামলাটি রায় ঘোষণার পর্যায়ে এসেছে সবার অগে।
রক্তক্ষয়ী লাগাতার আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের। এরপর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার। জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে দাবি করে অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা দেয়, এই অপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা হবে। ঘোষণা অনুযায়ী পরে ট্রাইব্যুনাল, প্রোসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গত বছর ১৭ অক্টোবর দুই মামলার বিষয়ে প্রথম শুনানি হয়। সেদিন প্রোসিকিউশনের আবেদনে ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
তার আগে গত বছরের ১৪ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রোসিকিউশনে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দাখিল করা হয়। অন্য দুই আসামি হলেন-সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয় গত বছর ১৪ অক্টোবর। ছয় মাস ২৮ দিনে তদন্ত শেষ করে গত ১২ মে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। গত ১ জুন প্রোসিকিউশন ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ দাখিল করলে তা আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানকে আত্মসমর্পণ করতে ১৬ জুন সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়। পরদিন সেই বিজ্ঞপ্তি দুটি জাতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হয়।
আত্মসমর্পণ না করায় তাঁদের পলাতক দেখিয়ে গত ১০ জুলাই বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। তাঁদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী মো. আমির হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই দিন আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এই মামলার রাজসাক্ষী হতে ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন করেন। পরে তাঁর আবেদন মঞ্জুর করা হয়। গত ৩ আগস্ট চিফ প্রোসিকিউটরের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিচারকাজ। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও সাক্ষ্য দেন এই মামলায়। রাজসাক্ষী হিসেবে গত ২ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য দেন আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।
সুপ্রিম কোর্ট ও আইসিটিতে বাড়তি নিরাপত্তায় সেনা মোতায়েনের নির্দেশ প্রধান বিচারপতির : সুপ্রিম কোর্টের গণসংযোগ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। নির্দেশনা অনুসারে আজ বৃহস্পতিবার সেনা মোতায়েনের জন্য সেনা সদর দপ্তরে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে।’
এফপি/অ