শিরোনাম: |
সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ-২০২৫-এর খসড়া নিয়ে ক্ষুব্ধ বিচারকরা। খসড়া অধ্যাদেশে বিচারকদের নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতি সংক্রান্ত কমিটিতে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলকে রাখার প্রস্তাবে এই ক্ষোভ। গতকাল বুধবার আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এ বিষয়ে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের অন্যতম প্রস্তাব ছিল। প্রধান বিচারপতির সংস্কার ভাবনার মধ্যেও এটা আছে। আমরা এ লক্ষ্যে অনেকদূর কাজ করেছি। কিছু বিষয়ে এখনো কিছু মতভিন্নতা আছে। সেটা নিয়ে আরেকটু আলাপের প্রয়োজন রয়েছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অধ্যাদেশটা উপদেষ্টা পরিষদে পেশ করা হবে। উপদেষ্টা পরিষদ যদি মনে করে, তাহলে এটা পাস করা হবে। আমার ধারণা, এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই সুপ্রিম কোর্ট পৃথক সেক্রেটারিয়েট করতে পারব।’
এর আগে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশের খসড়া উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উত্থাপনের জন্য গত সোমবার সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আন্তঃমন্ত্রণালয় সংক্রান্ত বাছাই কমিটির কাছে পাঠায় আইন মন্ত্রণালয়। আজ বৃহস্পতিবার খসড়াটি উপদেষ্টা পরিষদে ওঠার কথা ছিল। তবে অধ্যাদেশের খসড়া হাতে পেয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিচারকরা। বিষয়টি নিয়ে গত মঙ্গলবার সারা দেশের বিচারকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ) প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি, পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার খসড়া আইনে বিচারকদের বদলি ও পদায়নের জন্য গঠিত কমিটিতে মাননীয় বিচারপতি মহোদয় ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার পাশাপাশি নির্বাহী বিভাগের প্রতিনিধি তথা অ্যাটর্নি জেনারেলকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি সংবিধানের ১১৬নং অনুচ্ছেদ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মূলনীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৬নং অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, জেলা আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার দায়িত্ব একমাত্র সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত। বিচারকদের বদলি ও পদায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্বাহী বিভাগের কোনো প্রতিনিধির অংশগ্রহণ সংবিধানের এই বিধানের পরিপন্থি। প্রস্তাবিত কমিটিতে অ্যাটর্নি জেনারেলের অন্তর্ভুক্তি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত এবং ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায়ের মূলনীতির পরিপন্থি।
বৈপ্লবিক জুলাই অভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশ গঠনে প্রধান বিচারপতির ঐতিহাসিক রোডম্যাপ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বদ্ধপরিকর উল্লেখ করে এতে বলা হয়েছে, অ্যাসোসিয়েশন শুরু থেকেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বিচারকদের মর্যাদা ও স্বার্থ রক্ষায় সোচ্চার। বিচারকদের বদলি ও পদায়নের কমিটিতে নির্বাহী বিভাগের প্রতিনিধির অংশগ্রহণ সুস্পষ্টভাবে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ তৈরি করবে এবং এটা হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কারণ, অ্যাটর্নি জেনারেল সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হওয়া এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় উক্ত কমিটিতে তার অংশগ্রহণ বিচারকদের প্রভাবিত করবে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করবে। অ্যাসোসিয়েশন অনতিবিলম্বে উক্ত বিধান সংশোধন করে প্রস্তাবিত কমিটিতে শুধু বিচারপতি মহোদয় এবং বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের রাখার জোর দাবি জানাচ্ছে। মতভিন্নতা থাকায় আজ খসড়াটি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উঠছে না বলে সূত্র জানিয়েছে।
বিচার-কর্ম বিভাগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা নাগরিক সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায় থেকে দীর্ঘদিনের দাবি। এই সচিবালয় প্রতিষ্ঠার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। পাশাপাশি বিচার বিভাগ পৃথককরণ সংক্রান্ত ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায়েও বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয় করার কথা বলা হয়েছে। ওই রায়ের আলোকে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার পরও বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব থেকে যায়। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক সরকারের আমলে বিচার বিভাগ পৃথককরণের কাজ আর এগোয়নি।
গত বছর ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিচার বিভাগের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব নেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। দায়িত্ব নেওয়ার অল্পদিনের মাথায় গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর প্রধান তার অভিভাষণে বিচার বিভাগের সংস্কারের লক্ষ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। সে অনুযায়ী একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পাশাপাশি বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের রিপোর্টেও পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়। এরপর সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ-এ আইন মন্ত্রণালয় থেকে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়-২০২৫-এর খসড়া তৈরি করা হয়। খসড়ায় এই সচিবালয় প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা হিসেবে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ, সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ এবং মাসদার হোসেন মামলার রায়ের বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়েছে। খসড়ার ৮ নম্বর ধারায় বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা বিধান সংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। সাত সদস্যের এই কমিটির প্রধান হবেন প্রধান বিচারপতি। কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকবেন হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারপতি যার মধ্যে দুজন অধস্তন আদালতের বিচারক থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং একজন আইনজীবী থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত।
অংশীজনরা বলছেন, বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান সংবলিত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট গত ২ সেপ্টেম্বর এক গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন। রায়ে সংবিধানের বিদ্যমান ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল করে বাহাত্তরের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়েছেন। এ রায়ের ফলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান, ছুটি মঞ্জুরিসহ) শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব পুরোপুরি সুপ্রিম কোর্টের হাতে ফিরে এসেছে। এ অবস্থায় বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা বিধানের কমিটিতে নির্বাহী বিভাগের প্রতিনিধি রাখা হলে তা হবে সংবিধান পরিপন্থি। এ ছাড়া বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার যে চেষ্টা, তাও ব্যর্থ হতে পারে।
এফপি/অআ