বাংলাদেশের নৌবাহন খাতে নতুন ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। প্রতিষ্ঠার অর্ধশতক পর প্রথমবারের মতো নিজস্ব অর্থায়নে দুটি আধুনিক বাল্ক ক্যারিয়ার কিনছে রাষ্ট্রীয় এই সংস্থা। তবে এই ক্রয় সরাসরি চীন থেকে নয়-একটি অভিনব কৌশল অবলম্বন করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হেলেনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস এলএলসি-এর মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। ফলে জাহাজের উৎপত্তি চীন হলেও সেগুলো আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও জটিলতা ছাড়াই বিশ্ববাজারে চলাচল করতে পারবে।
বিএসসি-র ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেক জানান, মার্কিন প্রতিষ্ঠান হেলেনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস চীনের খ্যাতনামা ন্যান ইয়াং (Nan Yang) শিপইয়ার্ড এ নির্মিত দুটি জাহাজ বিএসসিকে সরবরাহ করবে। এগুলো সাধারণ পণ্য পরিবহনের উপযোগী এবং বহনক্ষমতা ৫৫–৬০ হাজার টনের মধ্যে।
সম্প্রতি সরকারি ক্রয় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রায় ৯৩৫ কোটি টাকায় জাহাজ দুটি কেনার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। প্রতিটি জাহাজের দাম ধরা হয়েছে ৩৮.৩৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার- যা দাপ্তরিক অনুমানের চেয়ে প্রায় ৪.৬ শতাংশ কম। অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী হওয়ার পাশাপাশি এই কৌশলগত সিদ্ধান্তকে বিশেষজ্ঞরা “দ্বিমুখী সাফল্য” বলছেন।
প্রযুক্তিগত দিক থেকেও এগুলো অত্যাধুনিক। প্রতিটি জাহাজের ধারণক্ষমতা প্রায় ৬৩,৫০০ ডেডওয়েট টন। ব্যবহার করা হয়েছে কনট্রা রোটেটিং প্রপেলার, যা জ্বালানি সাশ্রয় করে গতিবেগ বাড়ায়। অ্যারোডাইনামিক ব্রিজ ডিজাইন বাতাসের বাধা কমিয়ে জাহাজকে করে তোলে আরও দ্রুত ও কার্যকর। নতুন হাল ডিজাইন পানির প্রতিরোধ কমিয়ে জ্বালানি খরচে সাশ্রয় আনে। পরিবেশ রক্ষায় রয়েছে সিলেক্টিভ ক্যাটালিটিক রিডাকশন প্রযুক্তি, যা ক্ষতিকর নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করে। ইউরোপীয় ও জাপানি যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত এই জাহাজগুলো আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থা (IMO)-এর সর্বশেষ পরিবেশগত মানদণ্ডও পূরণ করছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথম জাহাজটি ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর এবং দ্বিতীয়টি নভেম্বরে বহরে যোগ দেবে। বর্তমানে বিএসসির বহরে মাত্র পাঁচটি জাহাজ রয়েছে, যেখানে একসময় সংখ্যা ছিল ৪৪। ইউক্রেন যুদ্ধ, দুর্ঘটনা ও অগ্নিকাণ্ডের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনটি জাহাজ হারিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নতুন দুটি জাহাজ যোগ হলে বহরের সংখ্যা দাঁড়াবে সাতটিতে। বিশেষজ্ঞদের হিসাব বলছে, প্রতিটি জাহাজ বছরে আনতে পারবে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা রাজস্ব- অর্থাৎ বছরে ১৫০ কোটি টাকার নতুন আয়। পাশাপাশি প্রায় ১৫০ নাবিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
তবে এখানেই শেষ নয়। আগামী পাঁচ বছরে বিএসসি’র পরিকল্পনা আরও ২২টি জাহাজ কেনার। এর বাইরে দুটি বাল্ক ক্যারিয়ার ও একটি ট্যাংকার কেনার প্রক্রিয়া চলছে। একইসাথে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ছয়টি কন্টেইনার জাহাজ কেনার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। ফলে দীর্ঘদিনের স্থবিরতা কাটিয়ে বাংলাদেশ আবারও শক্তিশালী অবস্থানে ফিরতে পারবে বৈশ্বিক নৌবাণিজ্যে।
গত অর্থবছরে বিএসসি রেকর্ড ২৫০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে- যা আগের বছরের তুলনায় অভূতপূর্ব। আর্থিক সাফল্যই তাদের হাতে এনে দিয়েছে নতুন আত্মবিশ্বাস, যার প্রতিফলন হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে এই ক্রয়চুক্তি। কৌশল, অর্থনীতি ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে এই উদ্যোগকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সামুদ্রিক নীতির নতুন মাইলফলক।
এফপি/রাজ