বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ইঞ্জিন সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন যাত্রীবাহী ট্রেন চালাতে প্রয়োজন ৭২টি লোকোমোটিভ, কিন্তু চালু রয়েছে মাত্র ৫৩টি। ফলে মাঝপথে ইঞ্জিন বিকল হয়ে ট্রেন থেমে যাওয়া, শিডিউল বিপর্যয় ও যাত্রা বাতিল- এসব কারণে যাত্রীরা পড়ছেন সীমাহীন ভোগান্তিতে। একই সঙ্গে কনটেইনার ও তেলবাহী ট্রেন চলাচলেও সংকট মারাত্মক আকার নিয়েছে। প্রতিদিন পণ্যবাহী ট্রেনের জন্য দরকার ১৩টি ইঞ্জিন, অথচ সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ৫টি।
গত এক মাসে পূর্বাঞ্চলের অন্তত ১০ থেকে ১২টি ট্রেন মাঝপথে বিকল হয়েছে। ১৮ জুন পাহাড়তলী স্টেশনে বিজয় এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন বিকল হলে বিকল্প ইঞ্জিন না থাকায় ওয়ার্কশপ থেকে মেকানিক এনে তা মেরামত করতে হয়। একই দিনে ফৌজদারহাটে বিকল হয় তূর্ণা এক্সপ্রেস, ফলে কয়েক ঘণ্টা দেরি করে গন্তব্যে পৌঁছায় ট্রেনটি। সম্প্রতি গোধূলি এক্সপ্রেস, পর্যটক এক্সপ্রেস ও কক্সবাজার এক্সপ্রেসসহ আরও কয়েকটি ট্রেনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।
চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের এক কর্মকর্তা জানান, ট্রেন বাতিল হলে যাত্রীরা প্রায়ই বিক্ষোভ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্টেশন মাস্টার বলেন, “চট্টগ্রাম–সিলেট ও চট্টগ্রাম–জামালপুর রুটে নিয়মিত দেরি হচ্ছে, যাত্রীদের ক্ষোভ বাড়ছে।”
রেলওয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গত দেড় দশকে রেল খাতে দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হলেও ইঞ্জিন আমদানিতে অবহেলা করা হয়েছে। যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগ (মেকানিক্যাল ডিভিশন) নতুন ইঞ্জিন সংগ্রহ না করে পুরোনো ইঞ্জিন মেরামতের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহার ও গাফিলতির কারণে এসব ইঞ্জিন অল্প সময়ের মধ্যেই আবার বিকল হয়ে পড়ছে। অভিযোগ রয়েছে, মেকানিক্যাল বিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা উপেক্ষা করে অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এতে উন্নয়ন প্রকল্প ও যাত্রীসেবা পরিকল্পনা ব্যাহত হচ্ছে।
রেলের ওয়ার্কিং টাইম টেবিল অনুযায়ী, পূর্বাঞ্চলে প্রতিদিন ১১৬টি ইঞ্জিনের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ মিলছে মাত্র ১০০টি। যাত্রীবাহী ১৬০টি ও ৮টি কনটেইনার ট্রেন চালাতে প্রতিটি ইঞ্জিনকে গড়ে ৩টি ট্রেনে ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে পুরোনো ইঞ্জিনের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়ে বিকল হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। পশ্চিমাঞ্চলেও একই অবস্থা। সেখানে প্রতিদিন শতাধিক ইঞ্জিনের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ হচ্ছে গড়ে মাত্র ৮৭টি। এর ফলে যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলে নিয়মিত শিডিউল ভঙ্গ হচ্ছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সুবক্তগীন বলেন, “দীর্ঘদিন নতুন ইঞ্জিন আমদানি না হওয়া এবং পুরোনো ইঞ্জিনের ওপর চাপ বাড়ায় সংকট তৈরি হয়েছে। একটি বড় প্রকল্পের অর্থায়ন বাতিল হওয়ায় সমস্যা আরও বেড়েছে। তবে নতুন করে ৩০টি ইঞ্জিন আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। এগুলো যুক্ত হলে সংকট অনেকটাই কমবে।” তিনি আরও বলেন, “অনিয়ম ঠেকাতে নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে এবং দুর্নীতি বন্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে।”
পরিস্থিতি এখন এমন যে, যাত্রীবাহী ট্রেনের পাশাপাশি পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এতে যেমন সরকারের রাজস্ব আয় কমছে, তেমনি যাত্রীদের আস্থাও নষ্ট হচ্ছে। মাঝপথে ট্রেন থেমে যাওয়ায় প্রায়ই যাত্রীরা বিক্ষোভ করছেন, কখনও সংঘাতও ঘটছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অবকাঠামো উন্নয়ন ও নতুন রেললাইন নির্মাণ হলেও পর্যাপ্ত ইঞ্জিন না আনা গেলে রেলের অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়বে। তাই যাত্রীসেবার মানোন্নয়ন ও টেকসই উন্নয়নের জন্য দ্রুত আধুনিক ইঞ্জিন আমদানি এখন সময়ের দাবি।
এফপি/রাজ