দিনাজপুরের বিরল উপজেলার জোড়কালী এলাকায় একটি লিচু বাগানে পড়ে আছে হাজার হাজার মৃত মৌমাছি। কাঠের তৈরি বাক্সের পাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে নিথর দেহগুলো। বাক্সে থাকা মৌচাকগুলো খালি হয়ে গেছে। একসময় যেখানে মৌমাছির গুঞ্জনে সকাল শুরু হতো, আজ সেখানে নিঃস্তব্ধতা।
পাবনার ভাঙ্গুরা উপজেলার লামকান গ্রামের মৌচাষি আরজু আলম গত ২০ মার্চ ২০০টি মৌবাক্স নিয়ে এসেছিলেন দিনাজপুরে লিচুর মধু সংগ্রহ করতে। ১৫ বছর ধরে তিনি মৌমাছির খামার করছেন। অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে মধু সংগ্রহ করেন তিনি। পরিবার-পরিজন ও কর্মচারী মিলিয়ে ১০ জনের জীবিকা এই খামারের উপর নির্ভর করে। কিন্তু এবার শুরুতেই ঘটে গেল সর্বনাশ।
আরজুর অভিযোগ, খামার স্থাপনের তিন দিন পরেই স্থানীয় লিচু বাগানমালিকরা গাছে কীটনাশক ছিটিয়েছে। তখনো গাছে গুটি আসেনি। তিনি বলছেন, এই বিষাক্ত স্প্রের ফলেই তার সব মৌমাছি মারা গেছে। প্রতিটি বাক্সের চারপাশে পড়ে আছে মৃত মৌমাছির স্তূপ। কর্মচারীরা এখন ফ্রেম খুলে খালি চাক বের করছেন। মধু তো হলোই না, বরং মৌমাছিগুলোও হারিয়ে গেল।
মৌয়াল আবদুস সালাম বলেন, ‘আমরা শেষ হয়ে গেছি। মৌমাছি ছাড়া খালি বাক্স দিয়ে কী হবে? একটা বাক্সে মৌমাছিসহ কিনতে হলে খরচ পড়ে সাত থেকে আট হাজার টাকা। এতগুলো বাক্সে নতুন করে মৌমাছি বসানো আমাদের পক্ষে সম্ভব না।’
দিনাজপুর জেলায় প্রায় প্রতিটি উপজেলায় লিচুর আবাদ হয়। বোম্বাই, মাদ্রাজি, বেদানা, চায়না থ্রি, মোজাফফরি, কাঁঠালি – নানা জাতের লিচু উৎপন্ন হয় এখানে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এখানে ৫ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে ৫ হাজার ৪৫০টি লিচুর বাগান রয়েছে।
গত ১৫ বছর ধরে এই মৌসুমে মৌয়ালরা এখানে আসছেন লিচুর মধু সংগ্রহে। চাষিরাও মৌয়ালদের আগ্রহ নিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন। কারণ, লিচুর ফুলে মৌমাছির উপস্থিতি ফলন বাড়াতে সাহায্য করে।
এবারেও লিচুর মুকুল ভালো এসেছে। আরজু আলমের ভাষ্য, “আমাদের হাতে সময় ছিল মাত্র ১৫-২০ দিন। এই সময়টাতে আমরা দেড় হাজার বাক্স থেকে ২০-২২ টন মধু সংগ্রহ করতে পারতাম। বাজার দর অনুযায়ী, অন্তত ৬০ লাখ টাকার মধু হতো। কিন্তু আমরা সংগ্রহ করতে পেরেছি মাত্র আড়াই টন। বাকি সব মৌমাছি মরে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “৫ এপ্রিলের পর যদি স্প্রে করতো, তাহলে আমাদের ক্ষতি হতো না। তখন মধু সংগ্রহ শেষ হয়ে যেত। এবার ঈদটাও খামারেই কাটিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে, আমরা পথেই বসে যাবো।”
বিরল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোস্তফা হাসান ইমাম জানান, তিনি ২৩ মার্চ মৌয়ালদের কাছ থেকে কীটনাশক প্রয়োগের কথা জানতে পেরে নিজে গিয়ে বাগানিদের নিষেধ করেছিলেন। কারণ, তখনো লিচুর গুটি আসেনি, আর এই সময় স্প্রে করা নিয়মবহির্ভূত। তিনি বলেন, “মৌমাছি লিচুর ফলন বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখে। এ ধরনের সমন্বয়হীনতা দুঃখজনক।”
এখন মৌয়ালদের প্রশ্ন- পরের মৌসুমে কী তারা আবার সাহস করে খামার বসাতে পারবেন? মৌচাষ শুধু একটা পেশা না, এটা তাদের জীবনের অংশ। মৌমাছির ভনভনে গুঞ্জন ফেরাতে তাদের আর কতটা সময় লাগবে, সেটা এখনো অনিশ্চিত।
এফপি/রাজ