বর্ষা এলেই বেদে বহরের দেখা মেলে বদরগঞ্জ উপজেলার যমুনেশ্বরী নদীর চরে নির্জন এলাকায়। সেখানে নদীর তীরে তাবুর তৈরি অসংখ্য ছোট ছোট ঘর। ঘরে ভিতর ছোটখাট ছোটখাট আসবাবপত্র। তার উপর থালাবাসন ও রান্নার জন্য চুলো। বিছানায় ছড়ানো ছিটানো আছে নানা ধরনের গাছপালা, তাবিজকবজ ও বালিশের সাথে ঠাসা আছে ছোট বড় মাঝারী আকারের সাপ বোঝাই বাক্স। তার মধ্যেই পরিবার পরিজন নিয়ে গা ঘেঁষে গাদাগাদি করেন বসবাস করেন বেদেবহরের দল।
রংপুরের বদরগঞ্জ অঞ্চলে বর্ষা ঋতুর সাথে এই বেদে বহরের যোগসূত্র আছে আদিকাল থেকে। তারা প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে সাভার জেলার অমরপুর, পোড়াবাড়ী, কাঞ্চনপুর, বক্তাপুর ছোট অমরপুর এলাকা থেকে জীবিকার তাগিদে ছুটে আসে এখানে যমুনেশ্বরী নদীর ধারে। তাদের আসার আগাম কোন বার্তা পাওয়া যায় না। তারা এখানে হুট করেই চলে আসে চৌদ্দ পুরুষের বাধাধরা নিয়মে। তারপর নিজেদের মনোনিত জায়গায় ক্ষনস্থায়ী তাবুর ঘর নির্মাণ করে ৪/৫ মাস পর্যন্ত সেখানে বসবাস করার পর আবারো ফিরে যায় নিজেদের এলাকায়।
মঙ্গলবার (২২ জুলাই ২০২৫) বদরগঞ্জ পৌরশহর থেকে এক কিলোমিটার দূরে যমুনেশ্বরী নদীর উপর নির্মিত এরশাদ ব্রিজের আশেপাশে গেলে চোখে পড়ে একদল বেদেবহর। গত ৫ দিন আগে তারা এখানে এসেছে সাভার জেলা থেকে। সাভারের এই বেদেবহর এবছর মাত্র ১৬টি পরিবার নিয়ে এখানে এসে আশ্রয় গেঁড়েছে। প্রতিটি পরিবারে স্বামী স্ত্রী ছাড়া তাদের ২-৩টি করে ছেলে মেয়ে রয়েছে। তারা তাবুর বাইরে চারিদিকে হৈচৈ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার কোন তাবুতে দু’একজন ছাড়া সবাই আশেপাশের হাটবাজারও গ্রামগঞ্জে চলে গেছে জীবিকার তাগিদে। কেউ সাপের খেলা দেখাতে, কেউবা আবার গাছগাছড়া ও তাবিজকবজ নিয়ে ঘুরছে ভিন্ন কোন অসুখে আক্রান্ত নীরব রোগীর সন্ধানে। সন্ধ্যার আগে বাবা মায়ের বাড়ি ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছে কোমলমতি ক্ষুধার্ত শিশুরা।
এসময় প্রতিটি তাবু খুঁজতেই চোখে পড়ে বেদেবহরের সর্দারের ছোট্ট তাবুর ঝুপড়ি ঘরটি। এখানকার বেদেদের সর্দারের নাম আইনুল হক (৮২)। বয়সের ভারে অনেকটা মুটিয়ে গেলেও তাকে দেখে মনে হয় এখনো তার শক্তি সামর্থ রয়েছে পচিশ বছরের যুবকের মতই। তার সাথে কথা চলে প্রায় ঘন্টাব্যাপী।
বেদে সর্দার বলেন, আগের মত এই পেশার কদর না থাকলেও আদি পুরুষের বাধাধরা নিয়ম পালন করতে গিয়ে এখনো বহর নিয়ে ঘুরতে হয় দেশ থেকে দেশান্তরে। তবে আগের দিনের মতো গ্রামগঞ্জে সাপেকাটা ও তন্ত্রমন্ত্রের রোগী না পেয়ে রোজগার একেবারেই কমে গেছে। তাই অনেকেই এই পেশা বাদ দিয়ে এখন বিভিন্ন কল কারখানায় চাকরি বাকরি করছেন। কেউবা দেশের বাইরেও চলে গেছেন বিভিন্ন পেশা নিয়ে। এছাড়াও অনেকেই পুনর্বাসনের আশায় নিজেদের এলাকায় থেকে কোন না কোন ভাবে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আবার কেউ ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য বাড়িতে রয়ে গেছেন। ফলে ক্রমানায়ে ছোট হয়ে যাচ্ছে বেদেবহর।
যেমন গত বছর এই নদীর ধারে অর্ধশতাধিক পরিবার নিয়ে বহর নামলেও এ বছর মাত্র ১৬টি পরিবার এখানে এসেছে। আগামী বছর আমিও আর এখানে আসতে পারব কি না তা আল্লাহ পাকেই জানে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগের দিনে পিতামাতা ভাই বোন আত্মীয়-স্বজন নিয়ে নৌকায় চড়ে দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতেন বাংলার বেদেবহর। তাদের কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা বা ভোটাধিকার ছিল না বলে তাদেরকে বলা হত যাযাবর। কিন্তু আমাদের নির্দিষ্ট ঠিকানা ও ভোটাধিকার দুটোই রয়েছে তাই আমরা যাযাবর বা উদ্বাস্তু নই। তবে আমাদেরকে যাযাবর কিংবা বেদেবহর যাই বলা হোকনা কেন আমরা আসলে আপনাদের মত রক্তে মাংসে গড়া এদেশের মানুষ। আমাদেরও স্বপ্ন সাধ আছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আজ এই পেশায় আসতে বাধ্য করেছে।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি (সর্দার) বলেন, যে হারে দেশের মানুষ বনবাদাড়, গাছপালা ও স্বর্প জাতীয় প্রাণী ধ্বংস করে চলেছে। তাতে করে আগামী দিনে এদেশে অবহেলিত বেদেবহরের নাম মানুষের মন থেকে মুছে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এবিষয়ে বদরগঞ্জ মহিলা কলেজের জীব বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কামরুজ্জামান মুক্তা বলেন, যদিও বা তারা (বেদেরা) আমাদের উপজেলার মানুষ নয়। তারপরেও মানুষ হিসেবে তাদের জন্য আমাদের অনেক দায়িত্ব ও কর্তৃব্য রয়েছে। আমরা মানুষ হিসেবে অবশ্যই তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিৎ।
এফপি/রাজ