খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রেক্ষিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ প্রশমনের উদ্দেশ্যে গত ২৫ এপ্রিল তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ড. মোহাম্মদ মাছুদ ও প্রো- ভাইস চ্যান্সেলর ড. শেখ শরীফুল আলমকে অপসারণ করা হয়। যদিও আন্দোলনকারীদের অভিযোগের সঙ্গে তার সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না বলে জানা যায়।
কুয়েটের ছাত্র আন্দোলন থামানোর পেছনে প্রয়োগ হয়েছে সরাসরি রাজনৈতিক শক্তি। প্রাক্তন ভিসি ড. মাছুদকে সরিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন ভিসি প্রফেসর ডঃ মোঃ হযরত আলীকে দায়িত্ব দেওয়ার পেছনে এনসিপির বহিষ্কৃত নেতা গাজী সালাউদ্দীন তানভীরের হস্তক্ষেপ প্রকাশ পেয়েছে।
রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস গড়তে রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটানোর বিষয়টি নতুন সংকট ডেকে এনেছে। ড. মাছুদের অপসারণে শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কুয়েটের শিক্ষক সমিতি এ ঘটনাকে ‘চাপের মুখে ন্যায় বিচারের পরাজয়’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ছাত্র আন্দোলন থামানো গেলেও এখন শিক্ষক আন্দোলনে দীর্ঘমেয়াদি অচলাবস্থায় পড়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।
গত ০১ মে ২০২৫ তারিখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে কুয়েটের অন্তর্বর্তীকালীন ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে চুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: হযরত আলীকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি শিক্ষকদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন এবং শিক্ষক লাঞ্ছনাকারীদের বিচারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
কুয়েটের অন্তর্বর্তীকালীন ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে চুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: হযরত আলীর নিয়োগকে ঘিরে নানা বিতর্ক ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এনসিপির বহিষ্কৃত নেতা ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গাজী সালাউদ্দীন তানভীরের প্রত্যক্ষ তদবিরেই এই নিয়োগ হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, গাজী সালাউদ্দীন তানভীর ছিলেন চুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২ কে ১১ ব্যাচের শিক্ষার্থী। সে সময় এই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান (০২ অগাস্ট ২০১১ থেকে ১৭ আগস্ট ২০১৩) এবং তার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন বর্তমান কুয়েট ভাইস চ্যান্সেলর ড. মো: হযরত আলী।
তাছাড়া, তানভীরের এক সহপাঠীর সাথে যোগাযোগ করা হলে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তানভীরের এডভাইজার ছিলেন ড. মো: হযরত আলী। সে শিক্ষার্থী আরও জানান, তানভীর চুয়েটে থাকাকালীন প্রায়ই হযরত আলী স্যারের সঙ্গে দেখা করে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নিতেন। পাশাপাশি, দু’জনেরই বাড়ি দেশের উত্তরবঙ্গে হওয়ায় সেই সম্পর্ক সময়ের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে বলে জানা যায়।
বিশ্বস্ত সূত্রের দাবি, কুয়েটের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. মো: মাছুদের অপসারণের পরপরই গাজী সালাউদ্দীন তানভীর ও ড. হযরত আলীর মধ্যে একাধিকবার ফোনালাপ ও কমপক্ষে দু’বার ব্যক্তিগত বৈঠক হয়। এসব বৈঠক হয়েছে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের একটি অভিজাত রেস্টুরেন্ট এবং মোহাম্মদপুরের একটি হাউজিং এলাকায়। বৈঠকগুলোতে পরবর্তী ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ, প্রশাসনিক কাঠামো, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডার নিয়ে আলোচনা হয় বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, ২৭ এপ্রিল চ্যানেল আইয়ের একটি সাক্ষাৎকারে গাজী সালাউদ্দীন তানভীর নিজেই স্বীকার করেন যে, তিনি কুয়েটের তৎকালীন ভিসি ড. মো: মাছুদকে সরানোর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তদবির করেছেন। পাশাপাশি, তার একাধিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টেও ড. মাছুদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ ও অপসারণে আগ্রহের স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে।
গাজী সালাউদ্দীন তানভীর ইতোমধ্যেই নানান রকম অপকর্মের অভিযোগে অভিযুক্ত। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে তানভীরের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক নিয়োগে প্রভাব বিস্তার, সরকারি প্রতিষ্ঠানে কেনাকাটায় কমিশন বাণিজ্যে ও এনসিটিবির ৪০০ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে এনসিপি থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। দল থেকে তার বিরুদ্ধে ঘটনা তদন্তের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। কুয়েটের বর্তমান ভিসির সাথে তানভীরের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চেয়ে উভয়ের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুয়েটের এক অধ্যাপক বলেন, কুয়েটের মত একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে একজন বিতর্কিত রাজনৈতিক নেতার সুপারিশে ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ পাওয়া প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার পরিপন্থী। এতে কেবল কুয়েটের পরিবেশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এ বিষয়ে কুয়েটের এক সিনিয়র অধ্যাপক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্বদানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে রাজনীতির ছায়া পড়লে সেখানে মুক্তচিন্তা, একাডেমিক স্বাধীনতা ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা ব্যাহত হয়। একজন বিতর্কিত ছাত্রনেতার সুপারিশে একজন ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হওয়া ন্যূনতম নৈতিকতার বিরুদ্ধাচরণ।
এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি, কুয়েটের মত একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এবং প্রশাসনিক পদে নিয়োগে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে অবিলম্বে সরকারকে যথাযথ তদন্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে ও সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
এফপি/রাজ